কবি হাসন রাজার বড়ো ছেলে গনিউর রাজা। তিনিও কবি ছিলেন, তিনটি খাতা ভরে তিনি গান লিখেছিলেন, নিজেই নাম দিয়েছিলেন ‘গনি সঙ্গীত’। একশটি গান নিয়ে তাঁর একটি গানের বইও বেরিয়েছিলো। কিন্তু আমাদের আলোচনা তাঁকে নিয়ে নয়। তাঁর আত্মজীবনী থেকে পাওয়া এক অভিনব ঘটনা নিয়ে। গনিউর রাজার লেখা থেকে জানা যায় এক বিদেশি তরুণীর কথা, যিনি একলা উড়েছিলেন ঢাকার আকাশে। ঢাকার আকাশের প্রথম গ্যাস বেলুনে করে। হয়তো কেউ জানতে পারতো না সেই তরুণীর কথা, যদি গনিউর রাজা তার কথা না লিখে রাখতেন।
সিলেটের গনিউর রাজা একবার ঢাকা গিয়ে লিখেছিলেন তাঁর ঢাকার দিনপঞ্জি। তার থেকে জিনেট ভান তাসেলের কথা জেনেছিলেন গবেষক শামীম আমিনুর রহমান। গনিউর রাজা জিনেটের আকাশে ওড়ার ঘটনাটি নিজেই দেখেছিলেন। সেই সময় ঢাকার আমোদপ্রিয় নবাব ছিলেন খাজা আহসানুল্লাহ। তিনি বিভিন্ন ব্যতিক্রমধর্মী আয়োজন করে নিজের এবং নগরবাসীর বিনোদনের ব্যবস্থা করতেন। গনিউর রাজার আত্মজীবনীতে দেখা যায়, শুধুমাত্র একটি বিকেলে বেলুনে উড়ে জনগণকে তাক লাগিয়ে দেওয়ার জন্য দশ হাজার টাকার বিনিময়ে নবাব একটি ভিনদেশী বেলুন কোম্পানির সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন। চুক্তিবদ্ধ হওয়ার পর ঢাক-ঢোল পিটিয়ে জনতাকে সেই চমকপ্রদ প্রদর্শনী দেখার জন্য আহ্বান জানানো হয়।
১৮৯২ সালের ১৬ মার্চ। বেলুনে ওড়ার পক্ষে দিনটি আবহাওয়ার দিক থেকে উপযুক্ত ছিল না। ফলে বেলুন কোম্পানী এবং জিনেটের সহযোগীও রাজি ছিলেন না। কিন্তু নাছোড়বান্দা নবাব অতিরিক্ত টাকা প্রদান করতে চাইলে সহযোগীর অনিচ্ছা সত্ত্বেও জিনেট পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে বিপজ্জনক অবতরণের জন্য সম্মত হন। বুড়িগঙ্গার দুই তীর, নদীসংলগ্ন দালান, আহসান মঞ্জিলের প্রাঙ্গণ ও ছাদ ভরে উঠেছিল মানুষে। উৎসাহী জনতা বসে ছিল মাঝনদীতে নৌকায়। বুড়িগঙ্গার তীর থেকে জিনেট বিশালাকায় এক বেলুনের নীচের কাঠের পাটাতনে চড়ে আকাশে ওড়েন। কিন্তু নামার সময় পূর্ব নির্ধারিত জায়গায় নামতে না পেরে মাটিতে পড়ে তাঁর মৃত্যু হয়।
১৮৯০ সালে আমেরিকা-ইউরোপে গ্যাস বেলুনের মাধ্যমে মানুষের আকাশে ভেসে বেড়ানো শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু অবিভক্ত বাংলায় আকাশে উড়ে বেড়ানোর কল্পনা করাও যেত না। এই সময়েই মার্কিন আকাশচারী জিনেট, প্রথম নারী হিসেবে ১৮৮৮ সালের ৪ জুলাই আমেরিকার লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের আকাশে বেলুনে করে প্রায় এক মাইল উঁচুতে উঠেছিলেন। এই জিনেটের জন্ম আমেরিকার সিনসিনাটির ওহায়ওতে৷ জিনেট পরিণত বয়সে বিয়েও করেছিলেন তাঁরই মত অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমী আকাশচারী পার্ক এ ভান তাসেলের সঙ্গে। জিনেট ভান তাসেলের নামটি ঢাকার ইতিহাসের সঙ্গে সারাজীবন জড়িয়ে থাকবে এই দুঃসাহসী অভিযানের কারণে। শেষপর্যন্ত সেই যাত্রার মর্মান্তিক পরিণতিও মনে রাখবে ঢাকা।
Discussion about this post