এই তো কয়েকবছর আগেও বাংলায় সিনেমার পর্দা হোক, বা বাস্তব জীবন হোক মেয়েরা গাড়ির বা মোটরসাইকেলের পিছনের আসনে বসে ঠোঁট ফুলিয়ে আদুরে ভঙ্গিতে গাইত, ”এই পথ যদি না শেষ হয়,তবে কেমন হত”। গাড়ির স্টিয়ারিং বা বাইকের চাকার সঙ্গে মেয়েদের সম্পর্ক ছিল অতটুকুই। তাছাড়া, শুধু বাংলা কেন, ‘মেয়েরা গাড়ি চালাতে অক্ষম, কারণ মেয়েদের মাথায় অত বুদ্ধি নেই’ এই ধারণা বা বিশ্বাস তো সারা বিশ্বের পপুলার সংস্কৃতির মধ্যে বিভিন্ন রূপে চালু আছে। শিক্ষিত, অশিক্ষিত, উচ্চশিক্ষিত সব ধরণের মানুষের মধ্যেই এই ধারণা জেনে হোক বা না জেনে হোক, কাজ করে। ফলে এই ভাবনাকে বদলানোর জন্য চাই শক্তি ও সাহস। তা করে দেখিয়েছিলেন এই বাংলারই সুষমা মিদ্যা।
মানসিক বাধা তো আছেই, তবে তার চেয়েও বড় বাধা হল সামাজিক বাধা। বাড়ির মেয়ে বাইরে বেরোলেই তাকে সাধারণত হাজারটা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। সেখানে মেয়ে চালাবে গাড়ি? আর তাতে সারাদিন ধরে বসবে অসংখ্য অচেনা মানুষ! কুড়ি বছর আগেও এ কথা ভাবা যেত না মোটেও। পাশ্চাত্য এই বিষয়ে অনেকটা এগিয়ে থাকলেও, মানসিক সঙ্কীর্ণতা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত বলে দাবি করা যাবে না। তবে হাওড়া জেলার সুষমা মিদ্যা সঙ্কীর্ণতা আর বাধা কে পিছনে ফেলে এগিয়ে এসেছেন তাঁর সংসার সামলাতে। তিনি কলকাতার উবের ক্যাবের প্রথম মহিলা চালক।
অন্ধ্রপ্রদেশের বাসিন্দা ভিরথ ভারতী ছিলেন ভারতের প্রথম মহিলা উবের চালক। তিনি এই কাজ শুরু করেছিলেন ২০১৩ সালে। কিন্তু যাবতীয় সম্মান, পরিচিতি সত্ত্বেও তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন, তদন্তকারীদের মতে সম্ভবত তিনি একাকীত্বে ভুগছিলেন। বাংলার সুষমা একা নন। স্বামী, পুত্র নিয়ে তাঁর সংসার। সকাল আটটা, সাড়ে আটটায় তিনি বেরিয়ে পড়েন, বাড়ি ফিরতে রাত্রি ১২টাও বাজে। তবে তাই নিয়ে সুষমার দুঃখ নেই। গাড়িই তাঁর প্রাণ। গাড়িতে সামান্য আঁচড় লাগলেও তাঁর প্রাণে আঘাত লাগে যেন। তাঁর জীবনে একটাই স্বপ্ন, ছেলে মানুষের মত মানুষ হোক, আর নিজেদের একটা বাড়ি হোক।
সুষমার প্রতিবন্ধী স্বামী আগে জুট মিলে কাজ করতেন। সেই কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরে তিনি টোটো চালান। সুষমা বলছেন স্বামী পাশে না থাকলে তিনি এতখানি এগিয়ে যেতে হয়ত পারতেন না। আর ‘মেয়েরা গাড়ি চালাতে পারে না, মেয়েদের কাজ রান্নাঘরেই সীমাবদ্ধ’ এই প্রচলিত ভাবনাকে তিনি বদলে দিতে চান। নারী চালক হিসেবে বহু অদ্ভুত ঘটনার সম্মুখীন তিনি হয়েছেন। কেউ তাঁর গলা শুনে বলেছে ‘আসল ড্রাইভার’কে ফোন দিতে, কেউ গাড়িতে উঠেই চোখ কপালে তুলে বলেছে ‘’মেয়েরা আবার গাড়িও চালাচ্ছে!’’ কিন্তু সুষমা কে থামানো যায়নি। হয়ত এভাবেই সুষমাদের থামানো যায়না।
Discussion about this post