“বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর, সবার আমি ছাত্র, নানান ভাবে নতুন জিনিস শিখছি দিবারাত্র।”- কবিতার এই লাইনগুলি শুনতে, পড়তে দিব্যি লাগে ঠিকই। কিন্তু আক্ষরিক অর্থে পালন করতে পারেন কয়জন? আজ আধুনিক যুগে পৃথিবী ভ্রমণ এমন কিছু বড় ব্যাপার নয়। বরং ভীষণ স্বাভাবিক। কারণ মানুষের হাতে পর্যাপ্ত অর্থ, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ইন্টারনেট, প্রযুক্তি সবই রয়েছে। কিন্তু কয়েক দশক আগে যিনি পৃথিবী ভ্রমণে বেরোতেন, তাঁর পক্ষে এটা কতখানি সহজ ছিল? আর তিনি যদি হতেন বাংলার মানুষ, তাঁর বাহন যদি হত একটা মাত্র সাইকেল, তবে?
বাংলায় যে কজন মানুষ ইবন বতুতা বা চিনা পরিব্রাজক হিউ এন সাং বা আরব্য রজনীর দাতা হাতেম তাঈয়ের নাম জানেন, তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগই রামনাথ বিশ্বাসের নাম জানেন না। উলটে বাঙালির নামে এই অপবাদ জুটেছে যে, বাঙালি ঘরকুনো। কিন্তু রামনাথ বিশ্বাস এই ভুল ভেঙে দিয়েছেন বহু আগেই। পারিবারিক কারণে তাঁর পড়াশোনা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত। পরবর্তীকালে হবিগঞ্জের জাতীয় ভান্ডার সমিতির ম্যানেজার পদ গ্রহণ, পরে গোপনে অনুশীলন সমিতিতে বিপ্লবী কাজে যোগদান তাঁর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আরম্ভ হলে তিনি যুদ্ধেও যোগ দেন। বাঙালি পল্টনের সঙ্গে তিনি মেসোপটেমিয়ায় যান। ১৯২৪ সালে তিনি মালয়ে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর চাকরিতে যোগ দেন।
১৯৩১ সালের ৭ জুলাই রামনাথ সিঙ্গাপুর থেকে একটি সাইকেল নিয়ে যাত্রা শুরু করেন। মালয়, চীন, কোরিয়া, জাপান হয়ে কানাডায় ১৯৩৪ সালে যাত্রা শেষ করেন। ওই বছরই দ্বিতীয় বার তিনি বেরিয়ে পড়েন। আফগানিস্তান, পারস্য, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, তুরস্ক, বুলগেরিয়া, যুগোস্লাভিয়া, হাঙ্গেরী, অস্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, জার্মানি, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, ব্রিটেন ও স্কটল্যান্ড ভ্রমণ করেন। ১৯৩৬ সালে তিনি লন্ডন থেকে জাহাজে দেশে ফেরেন। তৃতীয় বার মুম্বই থেকে জাহাজে মোম্বাসা পৌঁছে সেখান থেকে সাইকেল যাত্রা শুরু করেন। কেনিয়া, উগান্ডা, রোডেসিয়া হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকা; সেখান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৪০ সালে তিনি দেশে ফেরেন।
শুধু ঘুরে বেড়ানো নয়। এর পাশাপাশি তিনি নিয়মিত করে গেছেন লেখালেখি। রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্যও পেয়েছেন শান্তিনিকেতনে। কালা পানি পেরিয়ে পৃথিবী দেখে বেড়ানো মানুষটিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল জাত আছে কিনা। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, “আমার জাত চলে গেছে, আছে শুধু বাঙালিত্ব।’’ তিনি তাঁর নিজের ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখেছেন ৩০টিরও বেশি বই। যথার্থই সারা পৃথিবী হয়ে উঠেছিল তাঁর ক্লাসরুম। শুধু একটি সাইকেল, চটি আর চাদর নিয়ে তাঁর এই পরিভ্রমণ। ১০ বছরে প্রায় ৮৭ হাজার মাইল পথ তিনি পাড়ি দিয়েছেন। তাঁর জীবনবোধকে পরিণত করে তুলেছিল এই ভ্রমণ।
Discussion about this post