২০১০ সালের ২৮ মে। ঝাড়গ্রাম তখন পশ্চিম মেদিনীপুরেরই অন্তর্ভুক্ত। সেই জঙ্গলমহল এলাকার সরডিহা স্টেশনে গভীর রাতে সেদিন ঘটে এক মারাত্মক দুর্ঘটনা। কলকাতা-মুম্বই জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসের লাইনচ্যুত বগিতে এসে সজোরে ধাক্কা মারে দ্রুতগতিতে থাকা চলন্ত মালগাড়ি। তারপরই বিস্ফোরণের বিকট শব্দ আর আগুনের ঝলসানি। ১৪৮ জন যাত্রীর দেহ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে রেললাইনের উপর পড়ে। চারপাশ থেকে ছুটে আসছে বহু উদ্ধারকারীর দল। তারমধ্যে থেকেই একটা আওয়াজ ভেসে এল “আমি বাঁচতে পারব, আমায় বের করুন প্লিজ।” জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসের সেই ভয়াবহ দুর্ঘটনার কথা আজ সবাই ভুলে গেলেও ভুলতে পারেনি সেই মেয়েটা। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে একফোঁটা আশা নিয়েই যে বাঁচতে চেয়েছিল সেদিন।
আদ্যোপান্ত এক বাঙালি বাড়ির মেয়ে শ্রেয়া সেন। মুম্বই বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্কিটেকচার বিভাগের চতুর্থ বর্ষের ‘টপার’ সে। বছর পঁচিশের সেই তরুণীর দুচোখ ভরে তখন এক সফল আর্কিটেক্ট হওয়ার স্বপ্ন জ্বলজ্বল করছে। কিন্তু তাঁর জীবন যে এভাবে একদিন অন্ধকারে ঢেকে যাবে কেইবা তা জানত। আত্মীয়ের বিয়ে উপলক্ষে এসেছিলেন কলকতায়। আনন্দ অনুষ্ঠান শেষে এবার মুম্বাই ফেরার পালা। ট্রেনের আপার বার্থে তখন তিনি শান্তিতে ঘুমিয়ে। হঠাৎ গভীর রাতে এক প্রচন্ড ধাক্কা, অনুভব করলেন ট্রেনের বগি ক্রমশ উল্টে পড়ছে। আপার বার্থ থেকে ছিটকে পড়লেন তিনি। ব্যস তারপর সবটা অন্ধকার। যখন জ্ঞান ফিরল নিজেকে রক্তাক্ত অবস্থায় খুঁজে পেলেন ট্রেনের ওই ধ্বংসস্তূপের ভেতর। তখনও কাতরাচ্ছেন একটু সাহায্যের জন্য। আর্মি অফিসারের নজরে আসতেই তাঁকে উদ্ধার করে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। তখনও তাঁর ডানহাতে কোনো সাড়া নেই। একের পর এক অস্ত্রোপচার চলতে থাকে ওই দুর্বল শরীরে। আর তারপরই শরীর থেকে বাদ পড়ল তাঁর ডানহাত। চোখের সামনে তখন অন্ধকারে ছেয়ে গিয়েছে সবটা। সেই ছোট্ট থেকে দেখা আর্কিটেক্ট হওয়ার স্বপ্নের কি তবে এখানেই ইতি?
হার স্বীকার করা বোধহয় বাঙালির রক্তে কোনোদিন ছিল না। তাই শ্রেয়ার জীবনে এর পরের গল্পটাই হয়ে উঠল এক দৃষ্টান্ত। শারীরিকভাবে সুস্থ হওয়ার পরই ডান হাতের মায়া কাটিয়েই যোগ দিলেন ক্লাসে। শুরু হল নতুন করে স্বপ্ন গড়ার পরিশ্রম। সফটওয়্যারের সুযোগ না নিয়ে বাম হাত আর পায়ের সাহায্যে এঁকে চললেন আর্কিটেকের পঞ্চম বর্ষের থিসিস পেপারের নানা ছবি। বলাই বাহুল্য ডিস্টিংশন হাতে নিয়ে সফলতাও পেলেন। এরপর আইআইটি রুরকিতে পড়াকালীনই সুযোগ পেলেন জার্মানিতে গবেষণার। আর এখন? এখন তাঁর পরিচয় হল আর্কিটেকচারের এক সম্মানীয়া অধ্যাপিকা। ওদিকে থিসিস প্রোজেক্টর কাজও চলছে সমান তালে। বিয়ে সংসার সবটাই তিনি পেয়েছেন আজ।
কথায় বলে ‘যে সয় সেই রয়’ অর্থাৎ যে সহ্য করে সেই টিকে যায়। জীবনের পরতে পরতে রয়েছে অজানা নানা ঘটনার সমাবেশ। তার প্রতিটা হয়ত ঠিক মনের মতো নয়। কিন্তু সেই অজুহাতে যারা হাল ছাড়ে তারাই তলিয়ে যায় অতলে। হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে শ্রেয়া বুঝে ফেলেছিলেন বাঁচতে গেলে তাঁর ডানহাতকে সরিয়ে ফেলতে হবে শরীর থেকে। আর তারপরের দিন থেকেই বামহাতে শুরু হয় লেখার অভ্যেস। সেই অদম্য ইচ্ছেশক্তির জোরেই আজ তাঁর স্বপ্নের প্রতি পাতা এতটা সুন্দর। তবে আক্ষেপ একটাই আজও তাঁর নামের আগে ‘প্রতিবন্ধী’ কথাটি জুড়ে বসে। কিন্তু তিনি নিজেকে স্বয়ং সম্পূর্ণ বলেই মনে করেন আজও।
Discussion about this post