চিড়িয়াখানায় আমরা সাধারণতঃ কী দেখতে পাই? খাঁচায় বন্দী কিছু পশু বা পাখি রাখা রয়েছে আমাদের মনোরঞ্জনের জন্য। তাদের দেখতেই চিড়িয়াখানায় ছুটে যাই আমরা। কিন্তু মানুষ বন্দী করে রাখা চিড়িয়াখানার কথা কি আমরা কেউ জানি? শুনতে ভয়ানক লাগলেও, রীতিমতো এক বাস্তব ঘটনা। ইতিহাস সাক্ষী, এক কালে খাঁচায় বন্দী করে রাখা কিছু কালো চামড়ার ‘অসভ্য’ মানুষকে দেখার জন্য ভিড় জমাত ইউরোপীয় সাদা চামড়ার তথাকথিত সভ্য মানুষ। এমনকি তাদের নিয়ে হতো প্রদর্শনীও। টিকিট কেটে তা দেখতেও আসতেন লোকজন। তবে এ ঘটনা কিন্তু খুব বেশিদিনের নয়। উনবিংশ এবং বিংশ শতকের গোড়ার দিক থেকেই রমরমিয়ে চালু হয়েছিল এই ঘৃণ্য, নিষ্ঠুর প্রচলন।
১৮০৯ সালে ব্রাসেলস শহরে প্রথম এই চিড়িয়াখানার প্রচলন করেন রাজা কিং লিওপন্ড টু। নাম দেওয়া হয়েছিল ‘মানব চিড়িয়াখানা’। খাঁচায় বন্দী মানুষগুলির বেশিরভাগই ছিল আদিবাসী সম্প্রদায়ভুক্ত। আবার আফ্রিকার কালো চামড়ার মানুষও ছিল সেখানে। সারা বছরই তাদের খাঁচাতে বন্ধ করে রাখা হতো। সদ্যোজাত শিশু থেকে শুরু করে নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ, কালো চামড়ার প্রায় সবাই ছিল এই তালিকায়। তাদের নিয়ে গড়ে তোলা এই প্রদর্শনী দেখার জন্য উৎসুক থাকতেন উচ্চবর্গের সাদা চামড়ার মানুষ।
খাঁচায় বন্দী আফ্রিকার মানুষগুলি যেন আদতে মানুষই নয়, বরং তারা যেন পশুরও অধম! হ্যাঁ, ঠিক এমনভাবেই ব্যবহার করা হতো তাদের সঙ্গে। রাজা লিওপন্ডের মানব চিড়িয়াখানায় এক শীতে প্রায় ১০ জন মানুষ মারা গেলেও উচ্চবিত্ত সমাজে এর কোনও প্রভাবই পড়েনি। মানুষের প্রদর্শনী বন্ধ হওয়া তো দূর, বরং আরও বেশি বেড়ে গেল তা। ব্রাসেলস থেকে প্যারিস, সেখান থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়তে থাকে মানব চিড়িয়াখানার বীজ। বিশ্বের নানা দেশে বছরের পর বছর ধরে চলে কালো চামড়ার মানুষের প্রদর্শনী। এমনকি ওয়ার্ল্ড ফেয়ারের সময় বেলজিয়ামেও নাকি এই চিড়িয়াখানা চালু ছিল। উচ্চবর্গের মানুষের নিছক মনোরঞ্জনের জন্য গড়ে তোলা এই প্রথা কি সত্যিই ন্যায্য কোনও ঘটনা?
১৯৫৮ সালের পর থেকে অবশ্য বন্ধ হয়ে যায় মানব চিড়িয়াখানার এই প্রথা। কিন্তু বছরের পর বছর ধরে চলা এই অমানবিক, নিকৃষ্ট প্রথার স্মৃতির ক্ষত এখনও বয়ে বেড়ায় কালো চামড়ার নতুন প্রজন্মের মানুষগুলি। এমনকি বর্তমানেও রয়ে গেছে ঘৃণ্য সেই মানসিকতার রেশ। চিড়িয়াখানা আজ নেই বটে! তবুও সমাজের একটু অন্য সম্প্রদায় বা অন্যরকমের মানুষগুলোকে আমরা এখনও যেন ‘ভীন গ্রহের কোনও প্রাণী’র নজরেই দেখি। এর শেষ ঠিক কোথায়? উত্তর মেলে না আজও।
Discussion about this post