সাক্ষাৎকার নামক ব্যাপারটাই আসলে আকর্ষণীয়। আর সে সাক্ষাৎকার যদি হয় এমন মানুষের যিনি অকপটে বলতে পারেন, “শিল্প নিয়ে পলিটিক্স আমি ঘেন্না করি।” হ্যাঁ, ডেইলি নিউজ রিল আজ এমন একজনের সাক্ষাৎকার নিয়ে এসেছে, যার কন্ঠে সুরের সাথে ঘর বেঁধেছে কবিতার বন্দিশ। নিশ্চয়ই জানতে ইচ্ছে করছে কে তিনি? তিনি আর অন্য কেউ নন, তিনি হলেন প্রিয়াণ। তবে শিল্পী খোদ এটিকে সাক্ষাৎকার বলতে নারাজ। তাঁকে সম্মান জানিয়েই এটিকে বরং ‘আড্ডাৎকার’ বলে ডাকা যেতেই পারে। আর সেই আড্ডাৎকারের সাক্ষী থাকুন আপনারাও।
১. শিল্প চর্চার সঙ্গে আপনার বন্ধুত্ব ঠিক কবে থেকে?
শিল্প চর্চা জন্মের পর থেকেই। পাড়ার অনুষ্ঠানে কোনো এক কাকুর গান শুনে একেবারে ছোটবেলায় ভালো লেগেছিলো। আর মঞ্চে গিয়ে কিছু না বুঝেই হারমোনিয়ামের সবকটি রিড বাজিয়ে ফেলি। গানের আদ্যক্ষর পর্যন্ত না জেনে সা রে গা মা যখন বাজিয়ে ফেলেছি। কাজেই সঙ্গীত তো কোথাও একটা রয়েইছে।
২. দেশ আজ অনেকটা এগোলেও নারীদের শিল্প যাপনের ক্ষেত্রে প্রচুর সমস্যা আসে। পারিবারিক এবং সামাজিক সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে আপনি কীভাবে স্বাধীনচেতা শিল্পী হয়ে উঠলেন?
এই প্রশ্নটাকে আমি ভীষণভাবে সমর্থন করি। নারীদের সামাজিক স্তরে অনেকরকম বাধা আছে। আর সে সমস্ত বাধা কেউই কখনো আশা করে না। তবু সে বাধা জীবনে চলে আসে। কিন্তু আমি বরাবরই শিল্পকে বেঁধে রেখেছি আত্মার সাথে। আর বাকিদের জন্যও এটাই বলবো লক্ষ্যে স্থির থাকাটা ভীষণভাবে জরুরি।
৩. সঙ্গীত শিল্পী প্রিয়াণ নাকি কণ্ঠ শিল্পী প্রিয়াণ কোনটা বেশি চ্যালেঞ্জিং?
যারা সঙ্গীত শিল্পী তারা তো আসলে কন্ঠ শিল্পীও বটে। আজকাল গানের প্রকাশভঙ্গী যথেষ্ট পরবর্তিত। সেক্ষেত্রে শুধু একটা কোনো গান গেয়ে ফেললেই শিল্পীর শিল্পত্ব পুরোপুরি প্রকাশ পায় না। আর তাই সঙ্গীত শিল্পী হোক বা কন্ঠ শিল্পী, দুটোই একেবারে সমান চ্যালেঞ্জিং।
৪. আপনার কি মনে হয় যে আমরা এই মুহূর্তে এক ফ্যাসিস্ট সময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি? যদি তাই হয়, তাহলে মানুষ অন্ততঃ সাংস্কৃতিকভাবে একজোট হতে পারছে না কেন?
ফ্যাসিস্ট সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি তো অবশ্যই। মানুষ যে শোষিত হচ্ছে সেটা মানুষই অনুভব করতে পারছে না। আর রইল সাংস্কৃতিক ভাবে একজোট হবার কথা! সেটা আর হবে কী করে, শিল্পচর্চার চেয়ে বেশি ছড়িয়ে রয়েছে হিংসাত্মক মনোভাব। এক শিল্পী এক শিল্পীর পা ধরে টানছে, সে প্রত্যক্ষ হোক বা পরোক্ষভাবে। কোথাও শিল্পীরা বঞ্চনার শিকার হলে যদি একজন প্রতিবাদ করতে এগিয়ে যায়, তার সাথে আর কেউ থাকে না। ফলে স্বাভাবিকভাবেই শিল্পীদের একজোট হওয়া হয় না। আসলে বাঙালির স্বভাব হয়ে গেছে মুখে বলা, কিন্তু পালনের বেলায় লবডঙ্কা। আর তাই ফ্যাসিজম নিয়ে মুখে বললেও কাজের বেলায় কেউ নেই।
৫. রিয়েলিটি শো কি শিল্পী তৈরি করে নাকি শুধুই তারকা তৈরি করে?
দেখুন, রিয়েলিটি শো অবধি পৌঁছতে গেলে তাকে অবশ্যই শিল্পের হাত ধরে যেতে হবে। শিল্পসত্ত্বা না থাকলে সে ওই মঞ্চ অবধি যেতে পারবে না। তবে অবশ্যই রিয়েলিটি শো তারকা তৈরি করে বেশি। কিন্তু শিল্পী তৈরি করে না এমনটা নয়। একজন শিল্পী নিজের চর্চা অব্যাহত রাখলেও সে শিল্পী। তবে ওই আলো, মঞ্চ ইত্যাদির মাধ্যমে জনসমক্ষে তার কন্ঠ পৌঁছে গেলে সে শিল্পীর জীবনভর চর্চা পূর্ণতা পায়।
৬. বর্তমানে বেশিরভাগ অনুষ্ঠানেই আবৃত্তিকে খুব একটা গুরুত্বের চোখে দেখা হয় না। এ ব্যাপারে আপনার মতামত কী?
মানুষ রসালো জিনিস চায় বেশি, তার পরে শুষ্ক। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে মিউজিক একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও সঙ্গীতের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া যায় নাচকে। যেটা আবৃত্তির ক্ষেত্রে সেভাবে সম্ভব না। তবে হ্যাঁ, পার্থ ঘোষ, গৌরী ঘোষ, জগন্নাথ বসু, উর্মিমালা বসু কিংবা ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো শিল্পীরা আবৃত্তি নিয়ে যেভাবে নানান গবেষণা করেছেন, বর্তমানে কোনো শিল্পী যদি সাহস করে তেমন কিছু করতে পারেন তবে তিনি অবশ্যই সাফল্য পাবেন। তবে সেই সাহসটা দরকার। হয়তো পরবর্তীতে আবৃত্তি নিয়েও শুরু হতে পারে রিয়েলিটি শো।
৭. বাংলা সঙ্গীত জগৎকে ঘিরে নানা কিছু পলিটিক্স লক্ষ্য করা যায়। এটিকে আপনি কোন চোখে দেখেন?
সোজাসুজি আমি এই বিষয়টাকে ঘৃণ্য চোখে দেখি। দিনদিন সব অনুষ্ঠান বড় বেশি কর্পোরেট হয়ে যাচ্ছে। আমাদের সময়ে যে অনুষ্ঠান গুলো টিভিতে হত সেগুলো এত বেশি কর্পোরেট ছিল না। গ্ল্যামার তখনও ছিল তবে এতটা প্রাধান্য পায়নি। আর শিল্পীর সাথে পলিটিক্স চলে প্রতিনিয়ত এবং তার জন্য কোনো দল দরকার নেই। অস্থি মজ্জায় পলিটিক্স ঢুকে গিয়েছে আমাদের। পলিটিক্স খালি কথা দিয়ে নয় চলে সাইকোলজিক্যালিও। বারবার ঘুরে ফিরে একই কথা বলবো, একজন শিল্পীকে এগিয়ে দেওয়ার বদলে তার পা ধরে টানতে বাকিদের উৎসাহ বেশি।
৮. এখনও পর্যন্ত আপনার চোখে উল্লেখযোগ্য কী কী কাজ করেছেন?
আমি যে কাজই করি সেটাই আমার কাছে উল্লেখযোগ্য হয়ে যায়।’ প্রতিটা সৃষ্টি আসলে সন্তানের মতো তাতে আলাদা করে উল্লেখযোগ্য কিছু নেই। অনেক কাজই মাতৃত্বকালীন ছুটির কারণে বাতিল হয়েছে। তবুও যে গান, যে কবিতা তিনি লিখি বা পাঠ করি কিংবা গাই সবই আমার কাছে উল্লেখযোগ্য। ঠিক তেমনি আমার সৃষ্টি করা কোনো রান্নাও সমানভাবেই উল্লেখযোগ্য।
৯. এখনকার দিনে নতুন সঙ্গীতশিল্পীরা, বিশেষ করে যাদের গায়ে কোন টেলিভিশন চ্যানেলের ট্যাগ লাগেনি। তারা শো পাওয়া থেকে শুরু করে পেমেন্ট, সব ক্ষেত্রেই বৈষম্যের স্বীকার হন। কী বলবেন?
সেটা তো নিশ্চয়ই হচ্ছে। যে যতো বেশি নিজেকে প্রফেশনাল করে নিতে পারবে সেই উঠে আসছে বিশ্ব দরবারে। প্রফেশনাল বলতে শিল্প বা মননের কথা নয়। এ প্রসঙ্গে বলছি আর্থিকভাবে প্রফেশনাল হয়ে ওঠার কথা। তবে সবার তো সেই আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য নেই তাই অনেক শিল্পীই হারিয়ে যাচ্ছে। তবে শিল্পসত্ত্বা বাঁচিয়ে রাখতে গেলে রিয়েলিটি শোতে যেতে হবে তার কোনো মানে নেই। কেউ পাড়ায় ভালো গান গাইলে বা ভালো কবিতা বললে সে পাড়ার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের উচিৎ তাদের উৎসাহ দেওয়া, মঞ্চ দেওয়া। আর সেই সাথে অবশ্যই পারিশ্রমিক দিয়ে তাদের সম্মান জানানো। সে পারিশ্রমিক যে টাকাই হতে হবে তার কোন মানে নেই। তবেই আমরা ধীরে ধীরে শিখতে পারবো যে কোনো শিল্পীর থেকে শিল্পকে বিনা পারিশ্রমিকে নিংড়ে নেওয়া উচিৎ নয়।
সাক্ষাৎকারটি সম্পাদনা করলেন অন্তরা জানা (অজানা)
Discussion about this post