আজ থেকে ঠিক ১৫৯ বছর আগের কোলকাতা। তখন কোলকাতা শহর হাল-আমলের কলকাতার মত ইঁদুর দৌড়ে মেতে ওঠেনি। রয়ে সয়ে বাবুয়ানায় চলতো সেকালের তিলোত্তমা। তারই মাঝে কোনো এক বৈশাখের সোমবার ছিলো সেদিন। ১২৬৮ বঙ্গাব্দ, ২৫ শে বৈশাখ (ইং ৭ই মে, ১৮৬১, মঙ্গলবার), সময়টা ছিলো রাত ২ টো বেজে ২৮ মিনিট, ৩৭ সেকেন্ড। পৃথিবীর আলো দেখলো বছর চুয়াল্লিশের দেবেন্দ্রনাথ এবং পঁয়ত্রিশ বছরের সারদা সুন্দরী দেবীর অষ্টম পুত্র এবং চৌদ্দতম সন্তান। না! তখনও সে রবীন্দ্রনাথ হয়ে ওঠেনি, সে নেহাতই এক শিশু মাত্র।
ঠাকুরবাড়ি সম্পর্কে যতটুকু জানা যায় এবং দেখা যায়; ওই বাড়ির আঁতুড়ঘরটি ছিলো, তার থেকে সম্পূর্ণ বিপরীতে। বাড়ির সবথেকে ঠান্ডা এবং স্যাঁতস্যাঁতে ঘরটিতে বছরে এক মাস করে কাটাতে হতো বাড়ির বেশিরভাগ বউদের। সারদা সুন্দরীও তার ব্যতিক্রম ছিলেন না। যশোরের দক্ষিণদীহি গ্রামের রামনারায়ন চৌধুরীর কন্যা, দেবেন্দ্রনাথের অর্ধাঙ্গিনী। তিনি মা হতে লাগলেন প্রতি দেড় বছর অন্তর। জন্মের পর সাথে সাথেই মায়ের থেকে বাচ্চা সরিয়ে নেওয়ার রীতি ছিল ঠাকুর পরিবারে। বাচ্চা পেত না মায়ের দুধ। দুধ দেওয়ার জন্য ভরন পোষণ দিয়ে রাখা হতো দুগ্ধদাত্রী দাইমা’দের। বাচ্চার সম্পর্কে হতো সে, দুধ মা। ছোট্ট রবির দায়িত্ব নিলেন দিগম্বরী, ডাকনাম দিগমী। শোনা যায়, রবি তার ১৩ বছর বয়েস অবধি ছিলো দিগমী’র কাছেই।
ঠাকুরবাড়ির আরেক নিয়ম ছিলো, জন্মকোষ্ঠী বানানো। তাও আবার নামকরণের আগেই। জ্যোতিষী রামচন্দ্র আচার্য কৃষ্ণপক্ষে ত্রয়োদশীতে জন্ম নেওয়া নবজাতকের ভাগ্য নির্ধারণের পর লিখলেন, “কৃষ্ণপক্ষে ত্রয়োদশী, সোমবার, রেবতী মীন, শুক্রের দশা ভোগ্য।” যার দুটি অর্থ হতে পারে। প্রথমত, এই শিশু আজীবন কঠিন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীর বুকে এক অক্ষয় দাগ রেখে যাবে। দ্বিতীয়ত, ইন্দ্রিয়ই হবে তার প্রধান চাবিকাঠি। ইন্দ্রিয়ঘন অনুভবের মধ্যে দিয়ে সে উপলব্ধি করবে যাবতীয় অনুভূতিকে। আজ তার নামকরণ। বাড়ি জুড়ে চলছে দুইরকম রীতি মেনে প্রস্তুতি ও অনুষ্ঠান। ব্রাহ্ম ধর্ম অনুসারে চলছে উপাসনা। পাশাপাশি মেয়েলি রীতি মেনে চলছে, আটকৌড়ে আনন্দনাড়ু বিতরণ। বেনারসি কাপড়ের লাল জোড়ে সাজানো হয়েছে শিশুকে। শীঘ্রই শুরু হবে, নামকরণ অনুষ্ঠান। নামকরণ এবং অন্নপ্রাশনে পৌরোহিত্য করতে এসেছেন, শিবপ্রসাদ ভট্টাচার্য, ত্রিপুরা রঞ্জন সেনশাস্ত্রী, পণ্ডিত ভট্টনারায়ণ, পুরোহিত রত্ন কালীকিঙ্কর প্রমুখ। সব জোগাড় সুসম্পন্ন। কিন্তু শুরু হতে না হতেই থেমে গেল নামকরণের অনুষ্ঠান। কারণ অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠানে নারায়ণ শীলা অনুপস্থিত। প্রথমে ত্রুটি হিসেবে গণ্য হলেও পরে জানা গেল, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের আদেশেই এ হেন কাজ হয়েছে। কারণ দেবেন্দ্রনাথ মূর্তিপূজোর বিরোধী এবং তাঁর কাছে নারায়ণ শীলা নেহাতই এক প্রস্তরখন্ড। মুহূর্তেই লেগে গেল গন্ডগোল। অমঙ্গলের বার্তা ঘোষণা করে একে একে পুরোহিতরা উঠে গেলেন আসন ছেড়ে। বাড়ির মেয়েদের উৎসব কলোহর মুখগুলিতে নিমেষে নেমে এলো আশঙ্কার ছায়া। সকলের চোখ মহর্ষি’র দিকে। এমনই মেঘাচ্ছন্ন পরিবেশে মহর্ষি তাকালেন তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রের দিকে। যেন মেঘের মাঝে, এক টুকরো রোদের মতো হেসেই চলেছে সে। তিনি বুঝতে পারলেন, কোনো অমঙ্গলই স্পর্শ করতে পারবে না এই দ্যুতিমান দীধিতিকে।
তিনি একটি বড় আকারের চৌকো পিঁড়ি আনার আদেশ করলেন। তারপর বললেন, সেই পিঁড়ির চারিপাশে ছোট ছোট সারিবদ্ধ গর্ত করে, প্রতিটা গর্তে বসিয়ে দিতে মোমবাতি। নিয়ে আসা হলো রক্তচন্দন। তারপর তিনি অনেকক্ষণ কিছু বললেন না, তাকিয়ে রইলেন সেই পিঁড়ির দিকে। তিনি যেন একটি ছবির মতোই দেখতে পাচ্ছেন তাঁর অষ্টম পুত্রের ভবিষ্যৎ। তাঁর কানে অনুরণন ঘটাচ্ছে জ্যোতিষী রামচন্দ্রের কথা, তাঁর ভবিষ্যৎবাণী। মৃদু হেসে, রক্তচন্দনের অক্ষরে, পিঁড়ির মাঝখানে লিখলেন, সেই নাম। সেই নাম, যে নাম আজীবন মিশে থাকবে, বাঙালির রক্তে, যে নাম ভরসা দেবে, সাহস জোগাবে অনুক্ষণ। ‘রবীন্দ্রনাথ’।
আদেশ করলেন, সবকটি মোমবাতি জ্বালিয়ে দেওয়ার জন্য। মুহূর্তে জ্বলে উঠলো মোমবাতির সারি। এমন নামকরণ অনুষ্ঠানে স্তব্ধ সবাই। যেন এই আগুণের পরশমণি জ্বলে উঠেছে সকলের প্রাণে, জ্বলে উঠেছে ঊর্ধ্বপানে। সে যেন এক চেতনার প্রথম দীধিতি। যে নয়নের দৃষ্টি হতে সকল কালো ঘুচিয়ে আলো দেখাবে। সহস্র ব্যথার মধ্যে দিয়েও জ্বলে উঠবে এক অবিশ্বাস্য উন্মোচনে। না! সেদিন দেবেন্দ্রনাথ ভুল দেখেন নি। নয়তো সম্ভব ছিলো না এমন নির্ভুল নাম। একা রবি যেখানে ধরে রেখেছে, সমগ্র সৌর জগতকে।, সেখানে তিনি দেখতে পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে! যার অর্থ, সূর্যের সূর্য।
আজ রবির জন্মদিন। যে মানুষটা আমাকে তৈরি করেছে, আমায় সামলেছে, ভরসা দিয়েছে। যে অনুভূতি নিয়েই আমি রবির কাছে গিয়েছি, রবি সেই অগোছালো অনুভূতিগুলোকেই সবসময় গুছিয়ে দিয়েছে। হতে পারে সে সকলের কাছে বিশ্বকবি; নোবেল জয়ী রবিঠাকুর। কিন্তু, আমার কাছে সে সবসময়ই রবি। যার সাথে আমি হেসেছি, কেঁদেছি, ঝগড়া করেছি, ভালোবাসতে শিখেছি, বড় হয়েছি, যাকে জানতে জানতে। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু। আমার মনের, প্রাণের ‘রবি’…..
Author Intro – ঈশিতা দে (Esita Dey) freelance researcher Of Lifestyle Of RabindraNath, since 2011.
Rescuer, Storyteller @Rabir Aaloy (about rabindranath and non-human)
Discussion about this post