স্বাধীনতা দিবস হোক কি কোনো দেশনায়কের জন্মবার্ষিকী ভারতের তেরঙ্গা পতাকাটি আজ সগৌরবে আকাশ ছোঁয়া। মাথা নত নয় বরং তার সামনে মাথা উচিয়ে চলে একটা স্যালুট আর ‘বন্দে মাতরম’। সময়ের খোলসে স্বাধীনতার পর এগিয়েছে অনেক কটা বছর। ইতিহাসের পাতায় চাপা পড়েছে স্বাধীনতাকালীন নানা অজানা তথ্য। লুকিয়ে আছে ভারতীয় জাতীয় পতাকাটির তিনরঙা রঙের নানা ইতিবৃত্ত। চলুন তবে সেইসব যুগান্তকারী সিদ্ধান্তগুলোর নাগালে আজ একটু যাওয়া যাক।
বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ। দিকে দিকে তখন বঙ্গভঙ্গের ডাক। বাংলায় বঙ্গভঙ্গের বিরোধী আন্দোলনের তোলপাড়। ব্রিটিশ পরাধীনতার কাঁটা থেকে মুক্ত হতে মরিয়া ভারতবাসী। সেই পটভূমিতে দাঁড়িয়ে নিজের দেশের পতাকার প্রয়োজনীয়তাটা মাথাচাড়া দিল প্রত্যেকের। যে পতাকা হাতে নিয়ে চলবে বিদ্রোহের জ্বলন্ত দাবানল। সাল ১৯০৪। স্বামী বিবেকানন্দের সুযোগ্যা বিদেশী শিষ্যা ভগিনী নিবেদিতাই প্রথম ভারতীয় পতাকার রূপদানটি করেছিলেন। লাল চতুষ্কোণাকার, পতাকার কেন্দ্রে বজ্র ও শ্বেতপদ্ম সম্বলিত হলুদ ইনসেট। যার মধ্যে খোদাই ছিল বাংলা হরফে ‘বন্দে মাতরম’। লাল হল সংগ্রাম, হলুদ হল বিজয় প্রাপ্তি এবং শ্বেতপদ্ম শান্তির প্রতীক।
সাল ১৯০৬। পার্সি বাগান স্কোয়ারে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আলোচনা সভায় প্রথম তিন রঙের পতাকা প্রদর্শন হয়। যাকে ‘কলকাতা পতাকা’ বলা হয়ে থাকে। ওপর, মধ্য ও নিচে যথাক্রমে কমলা, হলুদ ও সবুজ রঙের তিনটি আনুভূমিক সমান্তরাল ডোরা। উপরের ডোরায় আটটি অর্ধ-প্রস্ফুটিত পদ্ম এবং নিচের ডোরায় সূর্য ও অর্ধচন্দ্র। মাঝে দেবনগরী হরফে ‘বন্দে মাতরম’ কথাটি। এরপর ১৯০৭ সালে জার্মানি শহরে অন্য একটি ত্রিবর্ণ পতাকা তোলা হয় ভিখাজি রুস্তম কামারের হাতে। ওপরে সবুজ, মধ্যে গেরুয়া ও নিচে লাল রং। সবুজ রং ইসলামের ও গেরুয়া হিন্দু ও বৌদ্ধধর্মের প্রতীক। সবুজ ডোরাটির উপর ভারতের আটটি প্রদেশের প্রতীক হিসেবে আটটি পদ্মের সারি। মধ্যের ডোরায় দেবনাগরী হরফে ‘বন্দে মাতরম’ এবং নিচের ডোরায় পতাকা দণ্ডের দিকে অর্ধচন্দ্র ও উড্ডয়নভাগের দিকে একটি সূর্য।
১৯১৬ তে মহাত্মা গান্ধীর অনুমোদনে একটি পতাকা তৈরী হয়। যদিও গান্ধীজীর মন্তব্যে পতাকাতে সকল সম্প্রদায়ের প্রতিফলন ঘটেনি। পরে গান্ধীজীর মতানুসারে একটি নতুন ত্রিবর্ণ পতাকার নকশা করা হয়। যার উপরে সাদা, মধ্যে সবুজ ও নিচে নীল। যা যথাক্রমে সংখ্যালঘু ধর্মসম্প্রদায়, মুসলমান ও হিন্দুদের প্রতীক। তিনটি ডোরা জুড়ে জ্বলজ্বল করত চরকার ছবি। যদিও জাতীয় কংগ্রেস এটিকে গ্রহণ করেনি। ১৯২৪ সালে আবার একটি পতাকার রূপ আনা হয়। তবে তাতে হিন্দু ও মুসলিমরাই প্রাধান্য পায়। তাই শিখরা অসন্তোষ দেখালে সেটিও বাতিল হয়। ১৯৩১ সালে আলোচিত পতাকায় হলদেটে কমলা এবং দণ্ডের দিকে চরকার চিত্র খচিত হয়। কিন্তু এটিও সাম্প্রদায়িকতার কারণে গৃহীত হলনা।
১৯৩১ এর করাচি অধিবেশনেই প্রথম বর্তমানের তিনরঙা পতাকাটি উত্তোলন হয়। যার মধ্যভাগ জুড়ে ছিল চরকা।গেরুয়া ত্যাগ, সাদা সত্য ও শান্তি এবং সবুজ বিশ্বাস ও প্রগতির প্রতীক। চরকা হল ভারতের অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ও দেশবাসীর শ্রমশীলতার প্রতীক। যদিও নেতাজীর আজান্দ হিন্দ বাহিনীর আদর্শের পতাকায় চরকার স্থানে ছিল লম্ফমান ব্যাঘ্র। গান্ধীজীর অহিংস আন্দোলনের বিপক্ষে নেতাজীর সশস্ত্র সংগ্রামের প্রতীক। এরপর এল ভারতের ইতিহাসে সেই পবিত্র সময়। রাজেন্দ্র প্রসাদের নেতৃত্বে মৌলনা আবুল কালাম আজাদ, সরোজিনী নাইডু, কে এম মুন্সী, বি আর আম্বেদকরের মত ব্যক্তিত্বের উপস্থিতিতে ১৯৪৭ এর ২৩ শে জুন পতাকা কমিটি তৈরী হয়।
সর্বজনগ্রাহ্য প্রস্তাবে স্থির হয় পতাকায় কোনো সাম্প্রদায়িক গুরুত্ব থাকবে না। তাই চরকার পরিবর্তে এল সারনাথের অশোক চক্র। ১৯৪৭ এর ১৫ই আগস্ট মুক্ত ভারতের মাটিতে উড়ল গেরুয়া সাদা সবুজের তিনরঙা এই পতাকাটি যার কেন্দ্রস্থল জুড়ে ২৪টি দণ্ডযুক্ত ঘন নীল অশোকচক্রটি। জাতীয় পতাকা খাদি কাপড়ে তৈরির নির্দেশ রয়েছে। আর এই কাপড়টি প্রসারে মহাত্মা গান্ধীজীর ভূমিকা অনন্য। বিদেশের মাটিতে যখন এই পতাকাটির হদিশ মেলে ভারতীয়ের মনে তখন অদ্ভুত ভালোলাগার স্নিগ্ধতা ঘিরে আসে। এই পতাকার শিরায় উপশিরায় আজও লেগে রয়েছে শত শহীদের কাঁচা রক্তের দাগ। গুলির গন্ধটা এখনও নাকের স্নায়ুগুলোকে সজাগ করে তোলে আজও। মনে করিয়ে চলে ভারতীয় ইতিহাসের সেই সাদাকালো অধ্যায়ের কথা।
Discussion about this post