মানুষের সঙ্গে বিভিন্ন পশু-পাখির বন্ধুত্বের কথা সাধারণতঃ অজানা নয়। বিশেষ করে কুকুর বা বিড়াল জাতীয় প্রাণীর সঙ্গে মানুষের বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তবে এই প্রাণীগুলো ছাড়াও হাতির সঙ্গেও মানুষের বেশ বন্ধুত্ব দেখতে পাওয়া যায়। বলিউডের ‘হাতি মেরে সাথী’ সিনেমায় আমরা দেখতে পাই মানুষের সাথে একটি হাতির গভীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক। সেই রকমই এক হাতির কথাই বলব যার মৃত্যুতে কেঁদেছিল প্রায় এক লাখ মানুষ।
মানুষের দেশ থাকে, দেশের সীমান্তে কাঁটাতার থাকে। হাতির সীমানা থাকে না। ২০১৬ সালে ভারতের আসাম থেকে বাংলাদেশ ভেসে আসে একটি হাতি। বন্যার জলে ভাসতে ভাসতে সে বাংলাদেশের জামালপুর নামে এক গ্রামের একটি বিলে চলে আসে। তারপর গ্রামের বাইরে এক মাঠের পাশে থাকতে শুরু করল সে। ইতিমধ্যেই গ্রামবাসীদের সঙ্গে হাতিটির বেশ বন্ধুত্ব হয়ে যায়। হাতিটির নাম ছিল ‘বঙ্গ বাহাদুর’। গ্রামের বাসিন্দারা আদর করে তাকে ‘মামা’ বলে ডাকত। সে কখনও কারও কোনও ক্ষতি করেনি। তাই অচিরেই গ্রামবাসীদের ভালবাসা আদায় করে নিয়েছিল। এমনকি এলাকাবাসীরা তার জন্য খাবারও সংগ্রহ করে আনত। এভাবেই এক বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কে তাদের দিন কাটতে থাকল।
কিন্তু হঠাৎ করেই এই কাহিনীটি গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার ফলে বাংলাদেশের বন বিভাগের কর্মকর্তারা সেখানে উপস্থিত হয়। বাংলাদেশ বন বিভাগ হাতিটিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ভারতীয় বন বিভাগকে অনুরোধ করে। কিন্তু ভারতের বনবিভাগ তাতে রাজি হয় না। তারা হাতিটিকে বাংলাদেশেই রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। ঠিক তারপরই শুরু হয় হাতিটিকে উদ্ধারের কাজ। বঙ্গ বাহাদুরকে উদ্ধার করতে প্রথমেই তাকে অজ্ঞান করার চেতনা নাশক ইনজেকশন দেওয়া হয়। সে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার পর তার পা শক্ত করে বেধে ফেলে বনবিভাগের কর্মীরা। তারপর তাকে সেই কাদা ভর্তি মাঠের মধ্যে ফেলে রেখে চলে যায় তারা। জ্ঞান ফেরার পর বঙ্গবাহাদুর প্রাণপণ চেষ্টা করে সেই বাঁধন থেকে নিজেকে মুক্ত করার। কিন্তু শেষমেশ হার মেনে কাদার মধ্যে পিছলে পড়ে যায়। পরদিন বন-কর্মীরা আবার ফিরে এলে হাতিটির অবস্থা দেখে আবারও তাকে অজ্ঞান করার ইনজেকশন দেওয়ার সিন্ধান্ত নেন। প্রথম তিনটি ইনজেকশন দেওয়ার পরও যখন সে জ্ঞান হারায় না, তখন চতুর্থবারের জন্য চেতনা নাশক ইনজেকশন দেওয়া হল তাকে। অতিরিক্ত ওষুধ প্রয়োগের পর একটু পরেই জ্ঞান হারায় বঙ্গবাহাদুর। বিকেল বেলা গ্রামবাসীরা তার এই অবস্থা দেখে তারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। হাতিটিকে আদরে ভালবাসায় ভরিয়ে তোলে তারা। কাদার ভিতর পড়ে থাকা বঙ্গবাহাদুর তখন যন্ত্রণায় ছটফট করতে থাকে।
পরদিন সকালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বঙ্গ বাহাদুর। অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে তিলে তিলে মারা যায় গ্রামবাসী দের প্রিয় ‘মামা’। গ্রামের বাসিন্দাদের কাছে সে ছিল প্রিয় এক বন্ধু। তাই তার মৃত্যুর খবরে চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি তারা। মিছিল করে এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদও জানায়। বঙ্গ বাহাদুর কখনো ছিল তাদের খেলার সঙ্গী, আবার কখনো বা ঘুরে বেড়ানোর বন্ধু। কিন্তু দিনের শেষে সে একাই চলে গেল কোনও এক অজানা না ফেরার দেশে। এই হাতির কষ্টে আজও কাঁদে বাংলাদেশের সেই গ্রামের মানুষ। ঠিক কতই না অবিচার হয়েছিল তার প্রতি! এই মানব জাতিকে সে কি কখনও ক্ষমা করতে পারবে? প্রশ্নটা আজও কাঁদায় সেই গ্রামের বাসিন্দাদের।
কভার চিত্র ঋণ – বাপ্পাদিত্য বসু
Discussion about this post