১৯৯৯ সালের ৩১শে জুলাই দিনটি অন্যান্য সাধারণ দিনের মতোই ছিল। কিন্তু ব্রহ্মাণ্ডের ইতিহাসে এক অভিনব ঘটনা ঘটে সেদিন। ‘লুনার প্রসপেক্টর স্পেস ক্রাফট’ সেদিন চাঁদের কক্ষপথে নামে। তবে একা নয়, সেটি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল কিছু দেহাবশেষ বা ছাইভস্ম। তারপর চাঁদের মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয় সেটি। দেহাবশেষটি ছিল ইউজিন শোমেকারের। তিনি পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম মানুষ, যার দেহাবশেষ চাঁদের মাটিতে পোঁতা হয়েছিল।
ছোটবেলা থেকেই ভূ-তত্ত্ববিদ্যা নিয়ে জানার আগ্রহ ছিল ইউজিনের। ‘ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি’ থেকে ভূ-তত্ত্ববিদ্যায় মাস্টার্সও শেষ করেন তিনি। এরপর যুক্তরাষ্ট্রের জিওলজিক্যাল সার্ভেতে যোগদান করেন তিনি। সেখানে ব্যারিংটন ক্রেটার নিয়ে গবেষণাও করেন তিনি। ব্যারিংটন ক্রেটার হল অ্যারিজোনা মরুভূমিতে অবস্থিত একটি বিশাল গর্ত। ইউজিনই প্রথম প্রমাণ করেছিলেন এটির সৃষ্টি হয়েছিল কোনও ধূমকেতুর পতনের ফলে। ১৯৬১ সালে আমেরিকার জিওলজিক্যাল সার্ভের ‘অ্যাস্ট্রোলজি সেন্টার অফ অ্যারিজোনাতে’ প্রথম ডিরেক্টর হিসেবে যোগদান করেন ইউজিন। সেখানে তাঁর মূল দায়িত্ব ছিল, কিভাবে চাঁদে সফলভাবে অবতরণ করা যায় এই নিয়ে গবেষণা করা। বহু বছর পরে গবেষণার শেষ পর্যন্ত সফলও হন তিনি। এমনকি অ্যাপোলো মিশনে চাঁদের মাটিতে পা রাখার জন্য নিজেকে তৈরিও করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাঁর এই ইচ্ছা অপূর্ণই থেকে যায়। এডিসন’স ডিজিজে আক্রান্ত হন তিনি। ফলতঃ তাঁকে চাঁদে পাঠানোর প্রস্তাব খারিজ করে দেয় নাসা।
১৯৯৭ সালের ১৮ জুলাই অস্ট্রেলিয়ায় এক গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা যান ইউজিন শোমেকার। তাঁর মৃত্যুতে বিজ্ঞান মহল জুড়ে শোকের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। ক্যারোলিন নামে ইউজিনের এক শিক্ষার্থী তাঁর চাঁদে যাওয়ার ইচ্ছার ব্যাপারে জানতেন। মৃত্যুর পর তাঁর দেহাবশেষ নিয়ে নাসার লুনার স্পেস ক্রাফটে দিয়ে আসেন। একটি পলি-কার্বোনেট ক্যাপসুলে ভরে সেই ভস্ম নিয়ে যাওয়া হয় চাঁদে। প্রায় এক বছর পর সেই স্পেসক্রাফট চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছালে সেই ক্যাপসুলটি চাঁদের মাটিতে ফেলে দেওয়া হয়। ইউজিন তাঁর বহু গবেষণা দিয়ে ভূ-জ্যোতির্বিদ্যাকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। তাই তাঁকে যোগ্য সম্মান দিতে পুরো বিজ্ঞান মহলও বিশেষভাবে তৎপর হয়েছিল। অসুস্থতার কারণে জীবিত থাকাকালীন ইউজিন চাঁদের মাটিতে পা রাখতে পারেননি। মৃত্যুর পর সেই অপূর্ণ ইচ্ছাই পূরণ করলেন তাঁর ছাত্রী, যদিও একটু অন্য ভাবেই। কিন্তু তিনিই সেই একমাত্র ব্যক্তি, মৃত্যুর পর যাকে চাঁদে সমাহিত করা হয়েছিল। এভাবেই তাঁকে সম্মান জানিয়েছিল সারা বিশ্বের বিজ্ঞান মহল। পৃথিবীর ইতিহাসে তাঁর নাম তাই সোনার অক্ষরেই লেখা থাকবে।
Discussion about this post