সময় যখন হাওয়ার বিপরীতে দাড়িয়ে থাকে, আর মানুষ যখন সেই হাওয়ার ওপরই আস্থা হারিয়ে ফেলে। তখন পরিবেশ সম্পর্কিত সচেতনতার প্রয়োজনীয়তা যে একশো গুণ বেড়ে যায়, আজ তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে পৃথিবী। গত এক বছরের বেশি সময় ধরে অদৃশ্য এক শত্রুর সঙ্গে, অন্ধকারে, উল্টো দিকে কোন হাত ছাড়াই পাঞ্জা কষতে কষতে, গোলার্ধের সব মানুষই আজ কেবল শুদ্ধ, স্বাস্থ্যকর পরিবেশের কথা অনেক বেশি করে ভাবতে শুরু করেছে। আর সেই জন্যই পৃথিবীর মানুষের কাছে এবারের চলে যাওয়া পরিবেশ দিবসটা আর পাঁচটা পরিবেশ দিবসের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
গত পাঁচ দশক ধরে দেশের পরিবেশের কাণ্ডারি ছিলেন যিনি, সেই তেহরির প্রবাদপ্রতিম সুন্দরলাল বহুগুনা আজ আর আমাদের সাথে নেই। করোনা তাকেও কেড়ে নিয়েছে। এমনই সঙ্কটপূর্ণ সময়ে অস্ট্রেলিয়ার জলসম্পদ সংরক্ষণকারী, মিনা গলি, পৃথিবী জুড়ে জুন ২ থেকে ৫ জুন অবধি “ওয়ার্ল্ড রিভার রান” এর ডাক দিলেন। আর সেই ডাক শুনে ১১৫ টি দেশের মানুষ ফেসবুকের মাধ্যমে সাড়া দিল। যে তারা তাদের নিজ নিজ ভূখণ্ডে, নদীর জন্য দৌড়াবে। মুম্বাইতে বসে, আমিও সেই ডাককে অস্বীকার পারলাম না। ৩৪ বছর আগে সুন্দরলাল বহুগুনার হাত ধরে যে সক্রিয় পরিবেশ রক্ষকের কাজ শুরু করেছিলাম, তাকে কী করে ভুলে থাকা সম্ভব।
১৯৮৭ সালে বহুগুনাজি, উত্তর কাশীর তেহরিতে গঙ্গা নদীর উপর বাঁধ প্রকল্প বন্ধ করার ডাক দিয়ে, গঙ্গাসাগর থেকে গঙ্গোত্রী অবধি এক সাইকেল যাত্রার আয়োজন করেছিলেন। সেদিনের সেই ‘গঙ্গা বাঁচাও’ আন্দোলনের পুরোভাগে দাঁড়িয়ে আমাকেই বহুগুনাজি ২০০ ছেলের একটি দলকে পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। বাংলা, বিহার, উত্তরপ্রদেশের গ্রাম, ছোট বড় শহর আর সকল জনপদে মানুষের মনে গঙ্গা নদীর গুরুত্বকে প্রতিস্থাপনের আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলাম। আর আজ সেই মানুষটা নেই বলে কি সব কিছু শেষ হয়ে যাবে!! তা হতে পারে না।
তাই পরিবেশ দিবসের সকালে, মিনা গলি’র ডাকে, মুম্বইয়ের উত্তর ভাগে প্রবাহিত দহিসর নদীর জন্য নেমে পড়লাম রাস্তায়। দৌড়তে থাকলাম সেই দহিসর নদীর পাড় ধরে, যা কিনা আজ একটি বড় নর্দমা ছাড়া আর কিছুই নয়। দৌড়ে ফেললাম 8 কিমি। ভাবতেও অবাক লাগে, সহ্যাদ্রি পর্বতমালা থেকে জন্মানো ছোট্ট এই দহিসর নদী মাত্র চল্লিশ বছর আগে পর্যন্ত মানুষের পানীয় জলের প্রধান উৎস ছিল। দৌড়তে, দৌড়তে নদীর পারে বসবাসকারী মানুষকেই জিঙ্গাসা করছিলাম, দহিসর নদী কেমন ছিল। রাজেশ নামের এক মাঝবয়সী গাড়ী মেকানিক জানালো, সে এই নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা বস্তিতেই জন্মেছে। তার ছোটবেলা এই নদীতে ঝাঁপাই জুড়েই কেটেছে। তারা এই নদীর জল খেয়েই বড় হয়েছে। শুধু তাই নয় সে আরো বললো, যে এই নদীর জল এত মিষ্টি ছিল, মানুষ আদর করে মিঠা নদীও বলতো।
বছর দশেকের সঙ্কেত, যে আমার মোবাইলে ছবি তুলতে সাহায্য করেছিল, সেও নদীর পাড়ের বস্তিতেই থাকে। কিন্তু সে জন্মে থেকেই এটা একটা নর্দমা বলে জানে। আমার কাছে এই নদীর আত্মকথা শুনে সে খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে জিঙ্গাসা করলো, “তাহলে তুমি কি এই নদীতে আবার জল আনবে?” আমি বললাম “তুই যদি সাথে থাকিস, হয়ত সম্ভব হবে কোনোদিন।” ও আমার মোবাইলটা ফিরত দিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো আমার দিকে। আমি আবার দৌড়তে থাকলাম নদীর পাড় ধরে এক নতুন আশা নিয়ে। ভাবতে থাকলাম, যে আমরা এটা ভুলতে বসেছি, এই নদীই আমাদের প্রাণের ধারা। মিষ্টি পানীয় জলের প্রবাহ নিয়ে চলে আর আমাদের বাঁচিয়ে রাখে যুগ যুগ ধরে। আপনিও আসুন আমার সাথে, নদী বাঁচাই, জীবন বাঁচাই।
কলমে – অরুণাংশু রায় চৌধুরী, প্রাক্তন প্রধান চিত্রসাংবাদিক দি হিন্দু, পরিবেশ সক্রিয়বাদী, ফিল্ম এবং ডকুমেন্টারি মেকার।
Discussion about this post