২০২০-২১ এর দীর্ঘ মহামারীকালের বিভীষিকা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই, ২০২২ পা’ দিয়েই বছরের চৌকাঠে মুখ থুবড়ে পড়ল পশ্চিমবঙ্গের মানুষ। রাজনৈতিক- অরাজনৈতিক, সামাজিক-অসামাজিক, আর্থিক-অনার্থিক, আদর্শ-অনাদর্শ, কেন্দ্র-রাজ্য, আবেগ-অভিমান আরো কত কী; একের পর এক ধেয়ে আসা সমুদ্রের ধেউ-এর মতো, রীতিমতো ধেয়ে এসে বাংলার মানুষের জামা কাপড়, মায় সর্বাঙ্গ ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছেই সেই সব ভিন্ন ভিন্ন বিতর্ক। নিস্তার চাইলেও পশ্চিমবঙ্গবাসীর কেমন যেন নিস্তার নেই এই সব বিতর্ক এবং তার পরবর্তী ভুল ঠিকের চাপান-উতোর থেকে।
কোনো একটা বিতর্কিত বিষয় শুরু হয়ে শেষ হওয়ার আগে পেছন থেকে বলিউডের কায়দায় কেউ যেন বলে উঠলো, “পিকচার আভি ভি বাকি হায় মেরা দোস্ত”— এই যে দাদা, আপনি কি জানেন না “মাউড়া হিন্দি”তে পশ্চিমবঙ্গে কথা বলা অপরাধ। কিন্তু আমাদের কি দোষ! গত পঞ্চাশ বছর ধরে বাংলায় কাজিয়া ছাড়া তো কিছু হচ্ছে না। কোন ভালো উদাহরণ দিতে গেলেই তো আমাদের হিন্দি, তেলুগু, তামিল বা মারাঠি ভাষার সাহিত্য, সঙ্গীত বা চলচ্চিত্রের ঝুলি খুলতেই হয়।
বাংলায় কোথায় পাওয়া যায় সেসব ‘ট্রেন্ডি মিম’! এই আবার বেফাঁস কিছু বলে ফেললাম। এক্ষুণি কেউ আবার আমার গলা টিপে ধরে বলবে, “বাঙালির ছেলে, রবীন্দ্রনাথটাও পড়ো নি!! নিদেন পক্ষে হেমন্ত-সন্ধ্যা’র দু-একটা গান তো শুনে রাখ্তেই পারো। সেগুলোও তো সময়ে কাজে আসে।” কিন্তু কি করে বোঝাই, একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে বাংলার দ্বাদশী থেকে অষ্টাদশী সব কিশোর-কিশোরীরাই যে আজ আর হেমন্ত-সন্ধ্যা’র গান আর রবীন্দ্রনাথের কবিতায় নিজেদের অভিব্যাক্তির রসদ খুঁজে পায় না। সময়ের সাথে সাথে তাদের জীবনের চাহিদাও বদলেছে এবং ক্রমাগতভাবে সেই চাহিদা আরো দ্রুত বদলে যাচ্ছে কারুর তোয়াক্কা না করেই।
তারা ভাষা না বুঝেই কোরিয়ান বা চাইনিজ কিম্বা লাতিন আমেরিকার গায়ক-গায়িকা এবং নাচিয়েদের সাথে বৈদুতিন মাধ্যমে ঝড় তুলেছে। সেখানে কারুর কোনো হাত নেই; নেই কোনো ষড়যন্ত্র। আর এটাই জীবনের প্রবাহমান ধারা, যা কিনা কোনো এক অবস্থানে কোনোভাবেই অবস্থিত নয়। তা সে যত সুন্দরই হোক না কেন! আগের যুগের সংস্কৃতি স্বর্ণময় ছিল বলে, মানুষ যে আগামী দিনে নতুন পদক্ষেপ নেবে না, তার কোন মানে হয় কি! কেউ আবার পিছন থেকে বলে উঠলো, “হয় হয় জানতি পারো না”। কি মশাই, কি জানতে পারি না, কোনটা জানতে পারি না। ভাই’পোর ‘ডায়মন্ড হারবার মডেল’, পিসি-ভাইপোর দলীয় নেতৃত্ব নিয়ে গা ঘষাঘষি।
১২৫ বছরের জন্মদিনেও বেচারা নেতাজী সুভাষ চন্দ্রকে রাজনৈতিক কারণে কেবলমাত্র বাঙালির আইকন বানিয়ে রাখার চেষ্টা। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সন্ধ্যা মুখার্জী আর অনিন্দ্য চ্যাটার্জীর পদ্ম পুরস্কার প্রত্যাখ্যানের খবর! তারপর সেই নিয়ে বাঙালী বুদ্ধিজীবীদের পতাকার রঙ দেখে বিস্তর চাটাচাটি আর বেচারা রশিদ খানকে পদ্ম পুরস্কার গ্রহণের জন্য বেজায় গালাগালি। শুধু কি তাই, বেচারা সাংবাদিক কি কুক্ষণে বাঙলার সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক সুমন চট্টোপাদ্ধ্যায় মহাশয়কে ফোন করে নিজের মা’কেই ধর্ষিত হতে শোনা। কি জানিনা বলতো? আর কি জানাতে চায় পশ্চিমবঙ্গের বাঙালী! এটাই তো, সন্ধ্যা মুখার্জীর গান ভাল না লাগলে, হয় আমাকে নতুবা আমার মা’কে ধর্ষণের হুমকি দেবে! এটাই তো, হিন্দি ভাষাকে ভালবাসলে আমার বাঙালিত্ব কেড়ে নিয়ে বলা হবে ‘মাউড়া’!
এটাই তো, যে সিপিএম নেতা নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর নামে কলকাতায় দেওয়াল লিখিয়েছিলেন, ‘নেতাজী তোজোর কুকুর”; বুনিয়াদি এবং উচ্চ-বুনিয়াদি শিক্ষায় ইংরাজি তুলে দিয়ে পশ্চিমবঙ্গবাসিকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে হারিয়ে দিতে চেয়েছিলেন যিনি, তাঁকে পদ্মভুষণে ভূষিত করার পরও, তিনি তা প্রত্যাখ্যান করবেন এবং তাকে নিয়ে আবেগপ্লুত হতে হবে। যিনি মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন নন্দীগ্রাম পুলিশি বর্বরতায় চোদ্দ জনের রক্তে মাটি ভিজে গেলেও বলেছিলেন, “They are being paid by the same coin”, তাঁকেও বলতে হবে সংস্কৃতিমনস্ক মানুষ। আসলে বাঙালি ভুলেই গেছে যে আদপে তারা কি চায়। কচুরিপানায় ঢাকা পাঁক গোলা পুকুরে রোজ ডুব দিতে দিতে তারা এতটাই বিভ্রান্ত, যে পরিস্কার জল কেমন হয় সেটাই বেমালুম ভুলে মেরে দিয়েছে। আর এরই মাঝে একদল স্বার্থান্বেষী, অর্থলোলুপ, চামচা বুদ্ধিজীবী পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে জোর করে বিভ্রান্ত করে রেখেছে, শুধুমাত্র নিজেদের দোকান চালিয়ে যাওয়ার জন্য। রোজ সকালে-বিকালে ফেসবুক, টুইটার আর ইন্সটাগ্রামে রসালো আলোচনা করে নিজেদের পকেটটা ভরিয়ে নিচ্ছেন তাঁরা। বিকল্প বিমুখ বাংলার সাধারন মানুষ শুনতে না চাইলেও শুনছেন, দেখতে না চাইলেও বাধ্য হয়ে দেখছেন।
নব্বই বছর বয়সে পশ্চিমবঙ্গ থেকে কয়েক হাজার কিলোমিটার দূরে অক্সফোর্ডে বসে নীরদ চন্দ্র চৌধুরী অনুভব করেছিলেন বাঙালী আত্মঘাতী। আজ আমাদের আবার কোনো বিশ্লেষক মানুষকে দরকার, যিনি বাঙালির এই বিকল্প বিমুখতাকে বিশ্লেষণ করতে পারেন। হে বঙ্গবাসী, তোমাদের সংস্কৃতি, আদর্শ, ঐতিহ্য– সমস্ত কিছুই সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে খুবই প্রিয়। সবাই তোমাদের ভাষার আর খাদ্যের মিষ্টতায় কোনো না কোনো সময়ে গা ভাষাতেই চায়। কিন্তু কারুর মা’কে ধর্ষণের হুমকি দিয়ে সংস্কৃতি, আদর্শ, ঐতিহ্যকে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টাটা নিতান্তই বর্বরোচিত। এটা অত্যন্ত দুঃখের যে ইদানীংকালে বাংলার গান, কবিতা ভারতবর্ষ তথা পৃথিবীতে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। কিন্তু তার জন্য দায়ী কে বা কারা? অবাক লাগে ভাবতে আজ ভারত তথা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে যে গানটা মানুষের মুখে মুখে ঘুরছে তা হল একটি তেলুগু চলচিত্র “পুষ্পা’র” গান। “চুপে বাঙ্গরা মায়েনে, শ্রীভল্লি মাটে মানিক্ক মায়েনে চুপে বাঙ্গরা মায়েনে, শ্রীভল্লি নুভে নভরত্ন মায়েনে”— যা বঙ্গানুবাদ করলে দাঁড়ায়, “তুমি তাকালে সোনা ঝরে, শ্রীভল্লি কথা বললে মানিক ঝরে, তুমি তাকালে সোনা ঝরে, শ্রীভল্লি হাঁসলে নবরত্ন ঝরে।” এর থেকেও অবাক করা ব্যাপার যে এই সুন্দর গানটি যিনি লিখেছেন তার নাম কানুকুন্টালা সুভাষ চন্দ্র বোস। বাঙালিরা অন্ধ্র প্রদেশের মনীষীদের নাম জানলেও তাদের নামে সন্তানদের নামকরণ করে বলে আমার জানা নেই। মাথায় বন্দুক দিয়ে, ধর্ষন করার হুমকি দিয়ে অথবা পা’ চাটা রাজনীতি করে আর যাই হোক, একটা জাতি বড়ো হতে পারে না। জাগো বাঙালী জাগো। নতুবা আগামী প্রজন্ম খুব মুশকিলে পড়ে যাবে।
Discussion about this post