আমরা সে অর্থে ‘বাংলা ব্যন্ড প্রজন্ম’। বছর দশ আগে যখন বাংলা ব্যান্ডের সিন রমরম করছে, আমাদের যৌবনও চড়চড় করে উড়ছে আকাশে। আহা কি সব দিন! গোলপার্কের নজরুল মঞ্চটাই যেন সন্ধ্যা হলে উডস্টক। অসংখ্য কালো কালো মাথা, গাঁজার ধোঁয়া, অসাবধানী চুমু পেরোতে পেরোতে ড্রামসের তালে তালে গর্জে উঠছে যৌবন। টেলিভিশন চ্যানেলে ব্যাণ্ডোদাদের রকস্টার ইমেজ আছড়ে পড়ছিল মধ্যবিত্তের অন্দরমহলে। ছড়িয়ে খানখান হচ্ছিল ‘সভ্য-সুশীল-ভদ্র’ নৈতিকতা। একটা বেহিসেবপনা একটা কেয়ারলেসনেস ভড় করেছিল আমাদের। যৌনতা বা নেশা নিয়ে ট্যাবুগুলো ফটাফট ভেঙে যাচ্ছিল। প্রতি সন্ধ্যা তাই বাঁধা থাকত ফসিলস-ক্যাকটাস-চন্দ্রবিন্দুদের নামে। আশির দশকে যেমন পাড়ায় পাড়ায় থিয়েটার করত ছেলেমেয়েরা, নব্বই তেমনি পেল ব্যন্ড, যা মহীনের ঘোড়ারা আগেই শুরু করেছিলেন। পিঙ্ক ফ্লয়েডের মতোই শহুরে সভ্যতার সাইকেডেলিক অভিজ্ঞতার গল্প, নৈরাশ্য ও অর্থহীনতার গল্প সেই বিকল্প রক সাউন্ড ক্রমশই ছড়িয়ে পড়ছিল গলিগলতায়। শহুরে গল্প ডালপালা মেলছিল আরও, শহর ও আধুনিকতাকে ঘিরে চালচিত্র বেড়ে উঠছিল। সেখানে গ্রাম্যতা ছিল না, ছিল স্মার্টনেস, কান্ট্রি ও প্রগ্রেসিভ রকে গল্প বলছিল যৌবন, বলছিল আশা-হতাশা, পারা-না পারা। আমরা বিশ্বাস করছিলাম আমরাও পারব আমাদের গল্প বলতে একদিন ঠিক, গানে বা সিনেমাতে…নিশ্চয়ই পারব…
আজ, এক দশক পিছিয়ে এসে বুঝি, বাংলা ব্যন্ডের এই স্বপ্নে অনেক ভুল ছিল। হয়তো সবচেয়ে বড় ভুল, যৌবনের সৎ আবেগকে ধরে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির হাতে বেচে দেওয়া। ইতিহাস না জেনে এবং শুধুমাত্র তিনটে কর্ড জেনেই গান বাঁধতে আসা অনেকের-এ রকম অনেক ফাঁক-ফোঁকর হয়তো ছিল। কিন্তু এসব সত্ত্বেও আজ ফিরে তাকালে আমার মনে হয়, অন্তত, আজকের থেকে আধুনিক ছিল সেই সময়টা…মধ্যবিত্ত রিগ্রেসিভ সিরিয়ালের বদলে বাধ্য হচ্ছিল বুঝতে মধ্যবিত্ত রকস্টার এটিটিউড। ক্যাকটাস বেঁধেছিল, “তুমিও বোঝো আমিও বুঝি, বুঝেও বুঝি না”র মতো গান, যা নাগরিক ডুয়াল স্ট্যান্ডার্ড প্রেমকে খুবলে আনছিল। ডিস্টরশন গিটার যে একটা সময়ের ভাষ্য তা আমরা অনুভব করে অজান্তেই আধুনিক হয়ে উঠছিলাম, তারপর গোলপার্কের রাস্তায় টুপটাপ প্রেম ঝরে গেল। অঞ্জন দত্ত সে প্রেম তুলে রাখলেন ‘ম্যাডলি বাঙালি’ ছবিতে, বন্ধুদের সাথে হেঁটে চলে যাচ্ছিলাম সারারাত..নানা রকম বাজনা শোনা-দেশ বিদেশের গান শোনা-ব্যান্ডের দাদাদের সাথে কত কত আলোচনা-রিহার্সালের পর রিহার্সালে কত কত সময় ব্যায় করা। তাকে ঘিরে কত কত প্রেম কত কত বন্ধুত্ব ভাঙা-ঝগড়া-রাগ-অশান্তি-নেশা-ফের সকালে আবার একজোট হয়ে বেজে ওঠা কোনও নতুন কলেজ ফেস্টে…
আজও সকালে উঠে মাথা ভালো কাজ না করলে হার্ড রক ব্যন্ড শুনি। শুনি ডেথ মেটাল। দেখি বেশ ঝকঝকে লাগছে। মনে পড়ছে, সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের এক সেমিনারে গেছিলাম সেই সময়ে, রক মিউজিক কি গান এ নিয়ে জোর হইচই উঠেছিল। বুড়োরা আমাদের এই মারে কি সেই মারে-বেয়াদপ ছেলেছোকরার তকমায়। কিন্তু সেই সেমিনারে আমাদের সমর্থন করেছিলেন নবারুণ, সোচ্চারেই বলেছিলেন, “আমার রক মিউজিক শুনতে ভালো লাগে। সকালে উঠে প্রায়ই শুনি।” আমরা হইহই করে উঠেছিলাম। আজ নবারুণ নেই। জুন মাসেই তার জন্মদিন। গত বছর এক মাস ধরে আমরা সেই জন্মদিনে নানা তথ্য খুঁড়ে বের করেছিলাম। নবারুণের সেই কথাটা আজ আবার মনে পড়ল। আমরা সত্তর দশক দেখিনি কিন্তু রক মিউজিকের মধ্যে ছিল একটা সত্তরের গর্জন তা টের পেয়েছিলাম। টের পেয়েছিলাম কেউ কেউ এ সমাজটা মেনে নিতে পারেনি, ভেঙে ফেলতে চেয়েছিল এসব কিছু। পারেনি, গানে রেখে গেছে সে বার্তা, এসব গান তারই প্রমাণ। আমাদের এরপর আধুনিক হওয়া ছাড়া কোনও উপায় ছিল না। হয়তো ভুল ছিলাম আমরা, কিন্তু ঠি ভাবে ঘুমোনোর থেকে সেই ভুল সচলতা খারাপ ছিল না…
ব্যান্ডের দাদারা অনেকেই আজ চুলটুল কেটে বিয়েটিয়ে করে সুখী সংসারী। মাঝেসাজে দেখা হলে, নিজেরাই লজ্জা পায়। কেউ চাকরি করে, কেউ বিদেশ কেটেছে..মূল ধারার ব্যান্ডরা সিনেমাতেই গান বেশি লেখেন। দশ বছর আগের সেই স্মৃতিগুলো কি তবে ভুল ছিল? আনমনে রাস্তা হাঁটতে হাঁটতে ভাবি..সন্ধ্যা হয়ে আসে আমার কলকাতায়..হঠাৎ পরের মোড়ে দেখা হয়ে যায় একদল কলেজ ছাত্রের সাথে, তারা জানায় তারা একটা পোর্টাল করছে। তাতে নিজেরাই গান গেয়ে পোস্ট করেছে এবং প্রচুর লাইক পেয়েছে। আমাকে তারা অনুরোধ করে এ প্রজন্ম নিয়ে কিছু কথা বলতে, ফোনের ক্যামেরা অন করে হঠাৎ। আমি দেখি সন্ধ্যা নামছে আমার শহরে..আমি বলি, আমার একটু তাড়া আছে, একটু পরে নজরুল মঞ্চ উডস্টক হয়ে উঠবে…
Discussion about this post