দুর্গাপুজো শুধুই কি ধর্মীয় উৎসব? বোধ হয় নয়।ধর্মের উর্ধ্বে উঠে যখন পুজো মিলিয়ে দেয় বাড়ির সকল সদস্যদের তখন শুধু ধর্মের বেড়াজালে আটকে থাকে না দুর্গোৎসব। ঠিক যেমন, দক্ষিণ দিনাজপুরের পতিরাম ঘোষ বাড়ির দুর্গাপুজো।
সেই এক কালের কথা। দেশে তখন ব্রিটিশদের শাসন। আত্রেয়ী নদীও তখন বেশ হৃষ্টপুষ্ট। নদীতে পারাপার হত বণিকদের বড় বড় নৌকা থেকে বজরা সবই।আত্রেয়ীর জলপথে বাংলাদেশ থেকে এলেন এক চালের ব্যবসায়ী। নোঙ্গর ফেললেন পতিরামে। বেশ ভালোই ব্যবসা হল। ব্যবসার খাতিরে পতিরামে যোগাযোগ নিয়মিত হল। ব্যবসায়ী রামসুন্দর ঘোষ এই এলাকাতে থাকার সুবিধার্থে বাড়ি বানালেন। এতে ব্যবসারও সুবিধা। ব্যবসায়ী হিসেবে বেশ নাম ডাক হল রামসুন্দর বাবুর। ধীরে ধীরে সেই এলাকায় ব্রিটিশদের সুনজরে পড়লেন। পতিরাম এলাকায় জমিদারির দায়িত্ব পেলেন রামসুন্দর বাবু।
তারপরই নিজের বসতবাড়িতে শুরু করলেন দুর্গা পুজো। চারদিনের এই পুজোয় গ্রামের মেজাজই পাল্টে যেত অনেক। পুরো এলাকাজুড়ে এই একটি মাত্র দুর্গাপুজো। ফলে গ্রামের লোকেদের উত্তেজনার শেষ ছিল না। এক সময় মহিষ ,পাঁঠা বলিও হত। পুজো উপলক্ষ্যে যাত্রা পালা, গানের আসর বসাত দূর থেকে আসা শিল্পীরা। বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীদের পুজোর আনাগোনা ছিল এই বাড়িতে।
তারপরে সময়ের সাথে বদলে গেছে সবকিছুই। জমিদারির নিয়মও ততদিনে তুলে দিয়েছে সরকার। ঘোষ পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যই বর্তমানে চাকুরিরত। পাড়ায় পাড়ায় পুজোর সংখ্যাও বেড়েছে। তাই পূর্বে পুজোকে কেন্দ্র করে এ গ্রামের লোকেরা যেমন উত্তেজনায় মেতে উঠত,সেসব ও সময়ের সাথে ফিকে হয়েছে অনেকটাই। তবুও ঘোষবাড়ির পুজোয় হাজির হয় অনেক দর্শনার্থী। কারণ ঘোষ বাড়ির পুজোকে ঘিরে থাকা আবেগ তারা কাটিয়ে উঠতে পারেননি এখনও। বলি প্রথাও উঠে গিয়েছে অনেক বছর হল।পুজোয় আগের মতো জাঁকজমক না থাকলেও মেনে চলা হয় বাকি সমস্ত নিয়ম। নিয়ম মেনেই করা হয় নারায়ণ পুজো থেকে চন্ডী পুজো। তবে এখানে অন্ন ভোগের আয়োজন নেই। পরিবর্তে মিষ্টান্ন ভোগ। ভোগ প্রসাদ বিলি করা হয় দর্শনার্থীদের মাঝেও।
সারাবছর বাইরে কর্মক্ষেত্রে বেশিরভাগ সদস্যরা থাকলেও পুজোয় বাড়িতে হাজির হন প্রত্যেকে। ‘আগমনীর সুরে’ বাড়ির লোককে ফিরে পেলে বাড়ির ইট-কাঠ ও যেন প্রাণ ফিরে পায় নতুন করে। আর এখানেই দুর্গাপুজো আবারও প্রমাণ করে কেন এই পুজো বাঙালির শ্রেষ্ঠ উৎসব!
Discussion about this post