ঠিক যেন সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘আমার বাংলা’র কোনো এক খন্ডচিত্র। তবে এই লেখা ‘গারো পাহাড়ের নিচে’র কোনো জনজাতিকে কেন্দ্র করে নয়। এই ছবি বক্সা-দুয়ারের। তারা মূল জনজীবন থেকে অনেকদূরে থেকেও অনেক বেশি জীবনমুখী। কর্পোরেট জীবনের সংজ্ঞাও হয়তো তাদের কাছে অজানা। প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেঁচে থাকাটাই যাদের জীবনের মূল রসদ।

বক্সা-দুয়ার উত্তরের সুন্দরী, যার টানে প্রতিবছরই উত্তরে ভিড় জমায় পর্যটকের দল। তবে বক্সা-দুয়ারের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য নিয়ে কম বেশি সকলে অবগত থাকলেও, সেখানকার বাসিন্দারা আজও দৃষ্টির অগোচরে। বক্সা-দুয়ারের সাঁতালাবাড়ি, জিরো পয়েন্ট, লেপচাখা, চূনাভাটি আরো কয়েকটি গ্রাম মিলিয়ে মোট ২৭টি জনজাতির বসবাস। সবথেকে উল্লেখযোগ্য বিষয় , এখানে বাঙালি-নেপালি-ভুটানি তিনটি ভিন্ন জাতি একসাথে থাকে। ভুটানিদের মধ্যে ‘দুকপা’রাই প্রধান। এই দুকপা এবং ভুটানের দ্রুকপা কিন্তু অভিন্ন।

সময়টা ১৮৬৪ সাল। ব্রিটিশ ইন্ডিয়া এবং ভুটানের ‘দুয়ার যুদ্ধে’র সময় বক্সা-দুয়ারের কিছু অংশ ইংরেজদের অধীনে আসে। সেইসময় ভুটানের দ্রুকপা জনজাতির একাংশ চলে আসে ভারতবর্ষে। বক্সা দুয়ারে দ্রুকপা ‘দুকপা’ নামে পরিচিতি পায়। দুকপারা আজও প্রকৃতির ছন্দেই স্বচ্ছন্দ্য। প্রকৃতির নিজস্ব নিয়মেই গড়ে তুলেছে নিজেদের। চাবচু গাছের পাতার তৈরী ছাউনির বাড়ি। বাড়ি বলতে ওই ছাউনিটুকুই। কোনো দরজা নেই। আসবাব বলতে একটিমাত্র মাচা। যার ওপরে রাত্রিযাপনটুকু সম্ভব। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় এখানে হিমালয়ান ভাল্লুক, চিতাবাঘ আর হাতি মাঝেমাঝেই হানা দেয় লোকালয়ে। তবুও এখানে মানুষ আর বন্য পশুর বোঝাপড়া কি আশ্চর্য্য এক ঘটনা! এই দরজা বিহীন, পাতার ছাউনির বাড়িতে হিংস্র পশুর উপদ্রবকে উপেক্ষা করে টিকে থাকা নেহাৎ মুখের কথা নয়।

বছরের বাকি সময় বাড়িতে কাটালেও বর্ষাকালে তারা স্বেচ্ছায় জঙ্গলে ‘গোঠে’ চলে যায়। তখন তাদের ক্ষুধা নিবারণের রসদ বলতে ফার্ণের পাতা, নদীর মাছ, আর বনের ফল। জীবনের প্রতি তাদের কোনো অভিযোগ নেই। সপ্তাহের দুটো দিন গোরুর দুধের মাখন তৈরী করে তারা বিক্রি করতে গ্রামে আসে। ওখান থেকেই যেটুকু আয়। অনেকে আবার পুরোপুরি পর্যটন শিল্পের উপরই নির্ভরশীল। পর্যটনই সেখানকার অর্থনীতির মূল স্তম্ভ। যারা অরণ্য থেকে এসে লোকালয়ে নিজেকে গড়ে তুলতে পেরেছিল তারাই আজ পর্যটনের সাথে যুক্ত। বাকিদের আজও ভরসা বলতে সেই অরণ্যই। আর বিনোদনের জন্য আছে রেডিয়ো। রেডিয়ো সেখানে থাকা না থাকা সমার্থক। এই জনজাতি পশ্চিমবঙ্গের কোনো বিচ্ছিন্ন অংশ নয়। তারাই আমাদের হাতে ধরে শিখিয়ে দেন, বেঁচে থাকতে গেলে শুধু ইচ্ছে টুকু দরকার। প্রকৃতি আমাদের অজান্তেই সমস্ত দায়ভার নিয়েছে সেই জন্মলগ্ন থেকেই।
চিত্র এবং তথ্য ঋণ – অর্ক দে
Discussion about this post