কলকাতার বনেদি বাড়ির দোলযাত্রার ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত কলকাতার ইতিহাসও। বাবু কলকাতার পারিবারিক বৈভব প্রদর্শন ছিল তার অন্যতম উদ্দেশ্য। তার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল নানা নিয়মবিধি। এক সময়ে, কলকাতার পুরনো বাড়িগুলির দোলের উৎসব ছিল খুবই জাঁকজমকপূর্ণ। প্রধানত গৃহদেবতাকে কেন্দ্র করেই জমে উঠত দোলের উৎসব। অবশ্য সেই সঙ্গে সামাজিক মেলামেশা এবং পারিবারিক বৈভব প্রদর্শনও ছিল বনেদি বাড়ির দোলের অন্যতম উদ্দেশ্য। দোল উপলক্ষ্যে অনেক বাড়িতেই গানবাজনার আসর বসত, ব্যবস্থা থাকত এলাহি খাওয়াদাওয়ারও।
চোরবাগান মল্লিক পরিবারের মার্বেল প্যালেসের দোল-উৎসব হয় পরিবারের তিন গৃহদেবতা জগন্নাথ, রাধাকান্ত ও গোপীচাঁদবল্লভকে ঘিরে। দোল পূর্ণিমার দিন সন্ধ্যায় এ বাড়ির হোলিকা দহন বা চাঁচর পোড়ানো অনুষ্ঠান। বাড়ির উঠোনে তৈরি করা হয় তিনটি চাঁচর-ঘর। তার সামনে তিনটি রুপোর সিংহাসনে বসানো হয় তিন দেবতার প্রতিভূ হিসেবে তিনটি শালগ্রাম শিলা। ঘিয়ের প্রদীপ ও মশাল জ্বেলে আরম্ভ হয় পুজো। তার পর ওই মশাল দিয়ে আগুন ধরানো হয় চাঁচর ঘরগুলিতে। হোলিকা দহন সম্পূর্ণ হওয়ার পর শালগ্রাম শিলা তিনটিকে শোধন করে ফিরিয়ে আনা হয় মন্দিরে। সেখানকার মূল বিগ্রহের সামনে শালগ্রাম শিলা বসিয়ে আবার পুজো করা হয়। অল্প আবিরও খেলা হয় তখন।
পরদিন সকাল সাড়ে চারটার সময়ে বসে দেবদোল। কাঠের দোলনায় শালগ্রাম শিলাগুলিকে বসিয়ে, দোল দিয়ে সূচনা হয় দেবদোলের। আরম্ভ হয় পুজো ও ভোগ নিবেদন। এখানকার দোলের প্রসাদে মালপো একটি উল্লেখযোগ্য পদ। তার পর বসে কীর্তনের আসর। আগেকার দিনে দোলের সময়ে এই রকম বৈষ্ণবীয় পরিবারে কীর্তন ছিল একটা বড় অনুষ্ঠান।
শোভাবাজার দেব পরিবারেরও দু’টি তরফ। পরিবারের প্রতিষ্ঠাতা নবকৃষ্ণ দেবের দত্তকপুত্র গোপীমোহনের পরিবারের অর্থাৎ বড় তরফের গৃহদেবতা ‘গোবিন্দ জিউ’ এবং নবকৃষ্ণের ছেলে রাজকৃষ্ণের পরিবার, অর্থাৎ ছোট তরফে গৃহদেবতা ‘গোপীনাথ জিউ’কে ঘিরেই এই দুই তরফের দোল-উৎসব। একই পরিবারের হলেও দু-তরফের দোলের অনুষ্ঠান হয় এক দিন আগে-পরে।
ছোট তরফের গোপীনাথ জিউ-এর দোল আগে। পরের দিন হয় গোবিন্দ জিউ-এর দোল। দু-তরফের প্রস্তুতি অবশ্য আরম্ভ হয়ে যায় দোলের বেশ কিছু দিন আগে থেকে। দেব পরিবারের সদস্যেরা এই সময়ে ব্যস্ত থাকেন পুজোর উপাচার সংগ্রহ থেকে আরম্ভ করে গৃহদেবতার সিংহাসন সাজানো, অতিথি আপ্যায়নের মিষ্টান্ন প্রস্তুতি ইত্যাদি নানা কাজে। দোলের ঠিক আগের দিন গোপীনাথ জিউর দোলের চাঁচর। বাড়ির ছেলেরা ঠাকুরদালানের সামনের উঠোনে তৈরি করেন খড়ের তৈরি ‘হোলিকা’ বা ‘মেড়া’। গৃহদেবতাকে ঠাকুরদালানের সিংহাসনে বসিয়ে সন্ধ্যার সময়ে পুজো করে আগুন দেওয়া হয় মেড়ায়। তার পর পুজো শেষ হলে আরম্ভ হয় গান। গান শেষ হলে হরির লুট দেওয়া হয় এবং সে দিন একটু ফাগ খেলাও হয় নিজেদের মধ্যে। সবশেষে থাকে ভূরিভোজ।
পরের দিন দোল। দেবদোলের পুজো আরম্ভ হয় ভোর চারটের সময়ে। এটি ছাড়া আরও দু’বার পুজো হয়। দ্বিতীয় বারের পুজো বেলা বারোটায় আর শেষ পুজো বিকেল চারটের সময়ে। ভোরে গোপীনাথের বিগ্রহে আবির-রঙ ছুঁইয়ে আরম্ভ হয় পরিবারের দোল খেলা। আবির ছাড়াও ভালো রঙ ও কুমকুমের ব্যবহারও হতো এক সময়ে। হৈ-হুল্লোড় করে দিন শেষ না হতে হতেই আরম্ভ হয়ে যাবে বড় তরফের গৃহদেবতা ‘গোবিন্দ জিউ’র চাঁচরের প্রস্তুতি। দু’বাড়ির রীতিনীতি প্রায় একই রকম, তফাৎ খালি দিনের। দোল-উৎসবের নিয়মকানুন আগেকার মতো থাকলেও জাঁকজমকে ভাটা পড়েছে অনেকটাই। তবু পুরনো রীতিনীতি বজায় রেখেই পরিবারের সদস্যেরা সামিল হন রঙের উৎসবে। শোভাবাজার দেব পরিবারের অন্যতম বৈশিষ্ট্য চাঁচরের গান। বহুকাল আগে পরিবারের সদস্যেরা দোলের গান লিখে সুর দিয়ে গিয়েছেন। পরম্পরা মেনে চাঁচরের দিন সেই সব গান গাওয়া হয়। পুরুষ-নারী নির্বিশেষে পরিবারের সকল সদস্য অংশগ্রহণ করেন সেই গানে।
এমন ভাবেই জাঁক জমকপূর্ণ ভাবে তখনকার বনেদী বাড়িগুলোতে দোল উৎসব পালিত হত। এখন রীতি-রেওয়াজটুকুই ধরে রাখা। সেই উল্লাস আর মাদকতা আর নাই।
Discussion about this post