“আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া কাল আমাদের দোল, পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে বলো হরি বোল।” এই প্রবাদ বাক্যটি হয়তো আমাদের সকলেই জানা। কারণ শ্রীকৃষ্ণের দোল যাত্রা পূর্ণিমা তিথি ছাড়া অসম্পূর্ণ। কিন্তু যদি কখনো এমনটা হয়, পূর্ণিমার তিথির পরিবর্তে অমাবস্যায় দোল উৎসব হচ্ছে! ভেবেছেন কখনো? তাহলে এই মুহূর্ত থেকেই ভাবতে শুরু করুন কারণ এমনটা সত্যি সত্যিই হয়। পশ্চিম মেদিনীপুরে অবস্থান করছে পাথরা জনপদ। এখানকার দোল উৎসব যেন এক অন্য জগৎ, অন্য পথ। এক অদ্ভুত কায়দায়, বিচিত্র ভঙ্গীতে এখানে দোল উৎসব পালন করা হয়। পূর্ণিমা তিথির বদলে দোল পালিত হয় অমাবস্যায়। দোল পূর্ণিমার ঠিক পনেরো দিন পরে। স্থানীয় মানুষ আদর করে এই উৎসবকে ‘বুড়িমার দোল’ নামেও ডাকেন।
দোল পূর্ণিমার ঠিক আগের রবিবার থেকে শুরু হয় ছৌ নাচ থেকে শুরু করে বাউল গান, অভিনয় থেকে শুরু করে লোকগীতি। পাথরার প্রতিটা মন্দির প্রাঙ্গণে এভাবেই চলে এক অভিনব অনবদ্য উৎসবের আসর। বাতাসে যেন ছড়িয়ে দেওয়া হয় আবিরের ইদ্রজাল। তারপর অমাবস্যা তিথির ঠিক দু’এক দিন আগে কাসর ঘণ্টা ঢোল করতাল সহ স্থানীয়দের রীতিমতো ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে দোল উৎসবের আমন্ত্রণ জানানো হয়। এই উৎসবের আরো একটি বিশেষত্ব হলো, এখানে নারী-পুরুষ, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলেরই প্রবেশ অবাধ। সবার জন্যই এক বিশেষ অন্নকূটের ব্যাবস্থা করা হয়। মন্দির প্রাঙ্গণে উপচে পড়ে মানুষের ভিড়। বর্তমানে পাথরা গ্রামটি একটি জীবন্ত জীবাশ্ম স্বরূপ। যার কান্ডারী হলেন এক মানবতার দূত ইয়াসিন পাঠান।
পাথরার ইতিহাসের পাতায় হাত বললে জানা যায় এক সময় ওই স্থানের চলছিল বিভিন্ন মন্দির, ভাষ্কর্যের ধ্বংসলীলা। কোথাও দুর্গা মন্দিরের মাকরা পাথরের ব্লক তো কোথাও প্রাচীন ইঁট সব খুবলে নিয়ে গিয়ে তৈরি করা হচ্ছিল বড়ো বড়ো ইমারত। বাংলার বুক থেকে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছিল ঐতিহ্যময় প্রাচীন সংস্কৃতি, মন্দির দেউলের গায়ে অলংকৃত শিল্প শৈলী। ঠিক সেই সময় এই সকল গোঁড়ামির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিলেন মাত্র ১৭ বছর বয়সী এক শীর্ণকায় মুসলিম যুবক ইয়াসিন পাঠান। যিনি নিজের প্রাণ দিয়ে আগলেছেন হিন্দু দেব দেবীর মন্দির। যিনি মনে করেন নামাজ পড়া পূজো করা যেমন প্রয়োজন , তেমনি প্রয়োজন বাংলার ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখা। যিনি একক উদ্যোগে শুরু করেছিলেন পাথরার অসংখ্য ঐতিহাসিক ও প্রাচীন পোড়ামাটির এবং ইটের মন্দিরগুলি বাঁচাবার প্রয়াস, পরবর্তীকালে তা অসংখ্য শুভাকাঙ্খীদের সাহায্যে সাফল্যমন্ডিত হয়।
১৯৯০ সালে স্থানীয় হিন্দু-মুসলিম-আদিবাসী সবাইকে নিয়েই তিনি গড়ে তোলেন “পাথরা পুরাতত্ত্ব সংরক্ষণ সমিতি”। তার নিদারুণ অধ্যবসায়, অক্লান্ত পরিশ্রম এবং কঠোর একাগ্রতা নিয়েই তিনি এগিয়ে চলেছিলেন তার লক্ষ্যের দিকে, শেষ পর্যন্ত পাথরায় টেনে এনেছিলেন এএসআই’কে মন্দির সংরক্ষণের জন্য। এত বড়ো একটি মহৎ কাজের কারনেই কিন্তু বর্তমানে অক্ষতভাবে টিকে ৩৪টি মন্দির। তাই পাথরার দোল সম্প্রীতির এক সুন্দর ছবি আঁকে, আসলে যে ছবি যুগ যুগ ধরে চিরন্তন ভারতের ছবিকেই মনে করিয়ে দেয়।
Discussion about this post