আলাস্কার পশ্চিমে অবস্থিত ছোট্ট শহর নোম। ১৯২৫ সালের জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সেই গ্রামে শ্বাসকষ্টে মারা গেল ছোট্ট দুটি এস্কিমো শিশু। গ্রামের একমাত্র চিকিৎসক ডাক্তার কার্টিস ওয়েলচের কপালে দেখা দিল চিন্তার ভাঁজ। এই রোগ গত ডিসেম্বর মাস থেকে দেখে আসছেন তিনি। গ্রামের বাইরে শহরের দিকে বেশ কয়েকটি শিশু মারাও গেছে এই রোগে। শুরুতে টনসিল বলে মনে হলেও এখন অন্য এক সন্দেহ উঁকি মারছে তাঁর মনে। এরপর বিল বার্নেট নামে অন্য আরেকটি শিশুকে পরীক্ষা করতে গিয়ে তিনি টের পান রোগটির আসল পরিচয়। সন্দেহ সত্যি হয় তাঁর, ডিপথেরিয়া। বিগত বিশ বছরে ড. ওয়েলচ এই রোগ দেখেননি। ভয়ঙ্কর রকমের ছোঁয়াচে এই রোগ। একমাত্র চিকিৎসা ডিপথেরিয়া অ্যান্টি-টক্সিন। না হলেই মৃত্যু আসন্ন।
নোমের একমাত্র হাসপাতাল ছিল মেইনার্ড-কলম্বাসে অ্যান্টিটক্সিন মজুত ছিল ঠিকই, কিন্তু তার মেয়াদও গিয়েছে ফুরিয়ে। নতুন ব্যাচের জন্য ডক্টর ওয়েলচ রাজধানী জুনোতে থাকা স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে চিঠি পাঠালেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বরফের জন্য নোমের একমাত্র বন্দর বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সেটি ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারেনি। আর কোনও উপায় না পেয়ে ডক্টর ওয়েলচ সাত বছরের বেসি স্ট্যানলিকে সেই এক্সপায়ার করে যাওয়া টক্সিন প্রয়োগ করেন। কিন্তু কোনো কাজ হল না। দিন শেষ হওয়ার আগেই মারা যায় বেসি। সেদিনই সন্ধ্যায় ডক্টর ওয়েলচের আবেদনে, সেখানকার মেয়র পুরো শহরকে ঘরবন্দী থাকার নির্দেশ দেন। সমস্ত স্কুল ও জনসমাবেশ বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং শহরবাসীকে অতি প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া ঘর থেকে বের না হওয়ার অনুরোধ করা হয়। জরুরি ভিত্তিতে মার্কিন সেনার সিগন্যাল কর্পসের মাধ্যমে এক মিলিয়ন ইউনিট ভ্যাক্সিনের আবেদন জানিয়ে গভর্নর স্কট বুন ও আলাস্কার প্রধান শহরগুলিতে টেলিগ্রাম করেন ড. ওয়েলচ। ওয়াশিংটনে ইউএস পাবলিক হেল্থ সার্ভিসের কাছেও একই রকম আরেকটি টেলিগ্রাম পাঠান হয় । কাছাকাছির মধ্যে একমাত্র ভ্যাক্সিনের মজুত ছিল নোম থেকে ১০০০ মাইল দূরে, অ্যাঙ্করেজ রেলরোড হাসপাতালে।
এই ভ্যাক্সিন কিভাবে নোমে পৌঁছাবে তা ছিল সবথেকে বড় প্রশ্ন। অ্যাঙ্করেজ থেকে রেলগাড়ির সাহায্যে ৩০০ মাইল দূরের শহর নেনানা পর্যন্ত ভ্যাক্সিন নিয়ে যাওয়া যাবে। কিন্তু সমস্যা তারপরই শুরু। নোমের একমাত্র বন্দর নভেম্বর থেকে জুলাই পর্যন্ত বরফে ঢাকা পড়ে থাকে বলে কোনও বাষ্পচালিত জাহাজ সেখানে ঢুকতে পারে না। তখন নোমের মেয়র উড়োজাহাজে করে ভ্যাক্সিন পাঠানোর প্রস্তাব রাখেন। কিন্তু সেই সময়ের প্লেনগুলিতে থাকত খোলা ককপিট, যা আলাস্কায় শীতকালের তীব্র ঠাণ্ডায় ব্যবহার করা যেত না। সুতরাং, শীতকালে নোমের মত দূর প্রান্তের শহরগুলিতে ডাক পৌঁছে দিতে ইউ এস পোস্টাল সার্ভিসের ভরসা ছিল ইডিটারড ট্রেইল। কুকুরের টানা স্লেজে করে ইডিটারড ট্রেইল ধরে ডাক ও অন্যান্য মালপত্র পরিবহন করা হত। সেই কথা মাথায় রেখেই বোর্ড অফ হেল্থের সভায় ডগ স্লেজ ব্যবহার করে ভ্যাক্সিন পৌঁছে দেয়ার প্রস্তাব ওঠে। পরিকল্পনা ছিল, একটি টিম নেনানা থেকে যাত্রা শুরু করে নেনানা আর নোমের মাঝামাঝি নুলাটো পৌঁছবে। একই সময় নোম থেকে আসা আরেকটি টিম সেখানে উপস্থিত থাকবে। তারপর তারা ভ্যাক্সিনের চালান গ্রহণ করে নোমে ফিরে যাবে। অর্থাৎ অনেকটা সেই রিলে রেসের মত।
তবে কাজটা শুনতে যতটা সহজ মনে হয় বাস্তবে ছিল ততটাই কঠিন। তাদের যাত্রাপথ ছিল আলাস্কার বরফের মধ্যে দিয়ে। যার একটা বড় অংশ বেরিং সাগরের উপর দিয়ে বরফে আচ্ছাদিত। তাপমাত্রাও ছিল সর্বনিম্ন, ওপরি পাওনা হারিকেনের মত তীব্র বাতাস। সবকিছু উপেক্ষা করে ছয় দিনের মধ্যেই নোমে ভ্যাক্সিন নিয়ে যেতে হবে। কারণ এর থেকে বেশি সময় নিলে ভ্যাক্সিন আর ব্যবহার উপযোগী থাকবে না। তখনও পর্যন্ত এই রাস্তা অতিক্রমের অফিশিয়াল রেকর্ড ছিল নয় দিনের। কিন্তু তৎকালীন আলাস্কার শ্রেষ্ঠ স্লেজ ডগ ব্রিডার ও ড্রাইভার যাকে সাধারণভাবে মাশার নামে ডাকা হয়, সেই লিওনহার্ড সেপালা এটিকে এক চ্যালেঞ্জ হিসাবেই নিলেন। যাত্রার জন্য এরপর তারা বিশজন মাশার ও তাদের কুকুরদের নিযুক্ত করা হয়। অ্যাঙ্করেজ রেলরোড হাসপাতালের চিকিৎসকেরা খুব যত্নের সঙ্গে ভ্যাক্সিনের চালান প্যাক করে দেন। সেই চালান নিয়ে সন্ধ্যার দিকে রেল নেনান পৌঁছায়। সেখান থেকে শুরু হয় ‘দ্য সিরাম রান’। যা ‘গ্রেট রেস অফ মার্সি’ নামেও পরিচিত।
লিড ডগের দায়িত্বে ছিল সাইবেরিয়ান হাস্কি প্রজাতির টোগোর কাঁধে। সেপালা ও টোগোর জুটি ছিল প্রায় কিংবদন্তির মত। দ্রুত কমতে থাকা তাপমাত্রা, তুষারপাত, তীব্র বাতাসের মধ্যে দিয়ে টোগো তার সহযোগী কুকুরদের সঙ্গে নিয়ে জীবনের ঝুঁকি উপেক্ষা করে এগিয়ে চলে। এরপর টেগো ও সাপালার যুগলবন্দীতেই বহু বাধা-বিপত্তি কাটিয়ে শেষ পর্যন্ত ভ্যাক্সিন এসে পৌঁছায় কাসেন নামে এক ব্যক্তির হাতে। কুকুর বাল্টোকে সঙ্গে নিয়ে নোম শহরে ভ্যাক্সিন নিয়ে নেমে আসেন তিনি। শেষ হয় ‘দ্য সেরাম রান’। এই দীর্ঘ যাত্রাপথের সমস্ত লাইমলাইটএসে পরে কুকুর বাল্টোর উপর। ব্রাত্য থেকে যায় টোগো। সংবাদপত্রগুলিতে বাল্টো আর কাসেনের উপর বড় বড় ফিচার লেখা হয়। নিউ ইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কে বাল্টোর মূর্তি ও স্থাপিত হয়। অনেকেই এর তীব্র সমালোচনা করেন। তাদের দৃষ্টিতে টোগোই ছিল আসল নায়ক।
সেরাম রানের উপর বহু বই লেখা হয়েছে। তৈরি হয়েছে চলচ্চিত্রও। ২০০৩ সালে প্রকাশিত ‘দ্য ক্রুয়েলেস্ট মাইল’ নামক বইতে সিরাম রানের কথা বলা হয়েছে। এলিজাবেথ রাইকারের লেখা ‘সেপালা: আলাস্কান ডগ ড্রাইভার’ বইতেও সেপালার নিজের বয়ানে সেরাম রানের বৃত্তান্ত পাওয়া যায়। ১৯৯৫ সালে বাল্টোকে নিয়ে ডিজনি একটি অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র তৈরি করে। এরপর ২০১৯ সালে তারা ‘টোগো’ নামে আরেকটি চলচ্চিত্রও প্রদর্শন করে। সেখানে সেরাম রানের ইতিহাস সঠিকভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এ কথা বলতে কোনও বাধা নেই যে ‘দ্য সেরাম রান’ হল প্রকৃতির বাধা-বিপত্তিকে তুচ্ছ করে মানুষের জয়ের এক গাথা। যেখানে জীবনের ঝুঁকি নেয়া অদম্য এক পাল কুকুরের কাছে মানুষ সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকবে।
Featured Image: halfarsedhistory.net
Image Courtesy – adn.com, haikudeck.com, aramink.wordpress.com, northernlightmedia.wordpress.com, dogpack.com, history.com
Discussion about this post