বেশ কিছুদিন আগে গুগলের ডুডলে একটা ছবি দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। ছবিটি ছিল খানিক এরকম, টাক মাথার একটি লোক হাত দেখাচ্ছেন আর তার পাশেই কেউ একজন হাত ধুচ্ছেন। এবার সবার মনে প্রশ্ন আসতেই পারে যে গুগল তাদের ডুডলে হঠাৎ এই ছবিটা কেন দিল? টাক মাথার ওই ব্যক্তিটিই বা আসলে কে? সেই মানুষটির নাম ইগনাস সিমেলওয়েজ, যিনি গোটা বিশ্ববাসীর কাছে ‘ফাদার অফ ইনফেকশন কন্ট্রোল’ এবং ‘সেভিয়ার অফ মাদার্স’ নামে পরিচিত। আর আজ সেই মানুষটির দেখানো পথ ধরেই করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে বাঁচার নির্দেশ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

১৮১৮ সালের ১ জুলাই হাঙ্গেরিতে জন্ম নিয়েছিলেন সিমেলওয়েইজ। তিনি ছিলেন একাধারে চিকিৎসক ও বিজ্ঞানী। ১৮৪৭ সালে ভিয়েনা জেনেরাল হাসপাতালের প্রসূতি বিভাগের চিফ রেসিডেন্ট হিসাবে যোগ দেন তিনি। তিনি যখন সেখানে কাজ করছেন তখন একটি বিষয় তার মনে দাগ কাটে। তিনি দেখলেন, কোন এক অজ্ঞাত কারণে সন্তান জন্ম দেওয়ার পরে মায়েদের মৃত্যুর হার অস্বাভাবিক রকমের বেশি। তিনি তখন ধারণা করেন যে, গর্ভবতী মায়েদের সংস্পর্শে আসার আগে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা অন্যান্য রোগীর থেকে জীবাণু বয়ে আনছেন। ঠিক সেই কারণেই মৃত্যু ঘটছে মায়েদের। তখনকার দিনে হাত ধোয়া নিয়ে মানুষের মধ্যে সচেতনতার বেশ কিছুটা অভাব ছিল। এমনকি খোদ ডাক্তাররাও এই ব্যাপারে খুব একটা সচেতন ছিলেন না। তিনি তখন ক্লোরিনেটেড লাইম সলিউশন ব্যবহার করে ওয়ার্ডের প্রসূতি মায়েদের দেখাশোনার নির্দেশ দেন। চিকিৎসক ও অন্যান্য কর্মীদের বারবার করে হাত ধোয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।

তখনকার দিনে সিমেলওয়েজের এই মতবাদ ছিল প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান ও ধারণার বিরুদ্ধে। তাছাড়া এই বিষয়ে কোনও যুক্তিগ্রাহ্য প্রমাণ তিনি দিতে পারেননি। ফলে তাঁর এই প্রস্তাবনাকে নাকচ করে দেয় মেডিকেল কমিউনিটি। এদিকে তার মতবাদ মেনে ভিয়েনা হাসপাতালে সংক্রমণের হার অনেকটাই কমে এসেছিল। কিন্তু তাঁর সহকর্মীদের একপ্রকার অপরিষ্কার বলায় এই মানুষটির ওপর তারা বেশ রেগেই ছিলেন। কিন্তু এতকিছুর পরেও নিজের বক্তব্যে অটল ছিলেন সিমেলওয়েজ। তাই তার প্রতি টিটকিরির পরিমাণ দিনের পর দিন বেড়ে যেতেই লাগল। এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ নার্ভাস ব্রেকডাউন এর শিকার হলেন তিনি। সেই সময় তাঁকে ষড়যন্ত্র করে মানসিকভাবে অসুস্থ আখ্যা দিয়ে মানসিক চিকিৎসা করতে পাগলা-গারদে পাঠিয়ে দেন তাঁরই সহকর্মীরা। সেখানে যাওয়ার ১৪ দিনের মাথায় গার্ডদের হাতে মার খেয়ে মৃত্যু ঘটে তাঁর।

পরবর্তীকালে ফরাসি মাইক্রো-বায়োলজিস্ট লুই পাস্তুরের জার্ম থিওরির হাত ধরে সিমেলওয়েজের প্রস্তাবনাটির সত্যতা প্রকাশিত হয়। ব্রিটিশ সার্জন জোসেফ লিস্টারও তাঁর অবদানের কথা স্বীকার করেছিলেন। আজ দুনিয়া জুড়ে করোনা ভাইরাসের হাত থেকে বাঁচতে সিমেলওয়েজের মতাদর্শ মেনেই হাত ধোয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তাবড় তাবড় চিকিৎসক। তাই এই দূরদৃষ্টি সম্পন্ন চিকিৎসকের অবদানকে সম্মান জানাতেই গুগল তাঁর ছবি দেয় তাদের ডুডলেও। করোনার বিরুদ্ধে আমাদের বাঁচা-মরার লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা সেই সিমেলওয়েজই।
Discussion about this post