পান্ডু নদীর ধারে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ঈদগাহ মাঠটি। মুঘলদের হাত ধরে বাংলাদেশে শুরু হয়েছিলো ঈদ আয়োজন। এই ধর্মীয় উপস্থাপনা তৈরি হয় ১৬৪০ খ্রিস্টাব্দে। বাংলাদেশের সুবাদার ছিল সম্রাট শাহজাহানের পুত্র শাহ সুজা। তার দেওয়ান ছিলেন মীর আবুল কাসেম। তিনিই নির্মাণ করেন এই শাহী ঈদগাহ মাঠ। কালের বিবর্তনে ঈদগাহটির অনেক অংশই বিলীন হয়ে গেছে।
তৎকালীন সময়ে ঈদগাহটি মুল শহর থেকে বেশ খানিকটা দূরে ছিল। মূল শহর অর্থাৎ পুরান ঢাকায় বেশ কয়েকটি সুলতানি ঈদগাহ থাকলেও বড় আকারে কোন ঈদগাহ ছিল না। তাই মীর আবুল কাসেম ঈদগাহের জন্য জায়গা খুজতে থাকে। অবশেষ তিনি ধানমন্ডি এলাকা বেছে নেন। মূল নগর থেকে কিছুটা দূরে খোলা জায়গায় এবং সাত মসজিদের কাছে হওয়ায় ধানমন্ডি এলাকাতে ঈদগাহটি নির্মিত হয়। সে সময় সাত মসজিদে জল ও স্থলপথ দুইভাবেই যোগাযোগ ব্যবস্থা ভাল ছিল। ঈদগাহের পাশ দিয়ে পান্ডু নদীর একটা শাখা প্রবাহিত হত, যা বর্তমান সাত মসজিদের কাছে বুড়িগঙ্গার সাথে মিলিত হত। প্রথমদিকে এখানে শুধু সুবেদার, নায়েবে নাজিম ও অভিজাত মুঘল কর্মকর্তা এবং তাদের স্বজনরাই নামাজ পড়তে পারতেন, সাধারণ নগরবাসীরা এতে প্রবেশ করার তেমন একটা সুযোগ পেতেন না।
পরে ঈদগাহটি সকলের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। ঈদের দিন বেশ ধূমধাম করে মিছিল নিয়ে এখানে নামাজে আসতো নগরবাসীরা। ১৭২৯ সালের এক রমজান মাসের কথা, বাংলায় তখন শাসন করছেন সুবাদার দ্বিতীয় মুর্শিদকুলি খাঁ। এই সময়ে ত্রিপুরা জয়ের খবর এল সুবাদারের কাছে। আনন্দে উদ্বেলিত সুবাদার তৎক্ষণাৎ হুকুম দিলেন গরিবদের মধ্যে হাজার টাকা বিতরণের। শুধু তাই নয়, তাঁর নির্দেশে ঈদের দিনে সুবাদারের আবাস লালবাগ কেল্লা থেকে ঈদগাহে যাওয়ার পুরো পথের দুই পাশে দাঁড়ানো মানুষের মাঝে ছড়ানো হয়েছিল মুঠি মুঠি মুদ্রা। সেই মুঘল আমল থেকে শুরু করে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে এখানে ঈদের নামাজ আদায় হতো। ঢাকার নবাব বাড়ি আহসান মঞ্জিল থেকে তোপধবনি করে চাঁদ ওঠার খবর জানানোর রেওয়াজ ছিল। ঈদের দিন নানা রঙের পতাকা হাতে নিয়ে ঈদ মিছিল সহকারে ধানমণ্ডি ঈদগাহে নামাজ পড়তে যাওয়া হতো।
বন্যা থেকে রক্ষা পেতে মাটির থেকে ৪ ফুট উঁচুতে আর দৈর্ঘ্যে ১৪৫ ফিট ও প্রস্থে ১৩৭ ফিট করে তৈরি হয় এই স্থাপত্য। পশ্চিম দিকের প্রাচীরটি মুঘল আমলে নির্মিত। আস্তর করা এ প্রাচীরের শীর্ষ প্রান্ত পারস্য রীতির ‘মোরলেন’ নকশা খচিত। আর প্রধান মেহরাব পশ্চিম প্রাচীরের মাঝ বরাবর। এর দুই পাশে দেখতে পাওয়া যায় আরো দু’টি ছোট আকারের মেহরাব। প্রধান মেহরাবটি অষ্টকোনাকৃতির। ভেতরের দিক সামান্য ঢালু খিলান আকৃতির। দেয়ালের ফ্রেমের ভেতরে অবস্থিত মেহরাবগুলো। বহু খাঁজবিশিষ্ট নকশা করা প্যানেল চোখে পড়ে প্রধান মেহরাবের দু’দিকে। এই ঈদগাহর চার কোণে রয়েছে অষ্টাভুজাকৃতির বুরুজ এবং তিন ধাপের মিম্বর। এ ছাড়া এই ঈদগাহের দেয়ালে মুঘল আমলে খোদিত শিলালিপি দেখতে পাওয়া যায়। সেখানে দাঁড়িয়েই ইমামরা ঈদের নামাজের খুৎবা পাঠ করে গিয়েছেন শত শত বছর ধরে।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধীনে থাকলেও, প্রাচীন এই স্থাপনাটিকে রক্ষার কোন সুচিন্তিত পরিকল্পনাও করা হয়নি। স্থাপত্যটির পূর্ব পাশের দেয়াল ভেঙে বানানো হয়েছে একটি মসজিদ। ঈদগাহটির খুব কাছেই নির্মাণ করা হয়েছে উঁচু উঁচু সব ভবন। একেবারে ইদগাহের দেয়াল ঘেষে টং দোকান, বস্তি ঘর, পুরানো পণ্যের ভাগাড়, আবর্জনার ট্রলি ইত্যাদিতে ভরা। ধর্মীয় এই ঐতিহ্য এখন বিলীন হবার পথে। চারিদিকে এত অব্যবস্থাপনা দেখে বোঝার উপায় নেই এখানে ইতিহাসের এতো বড় এক নিদর্শন রয়ে গেছে।
তথ্য ঋণ – জিয়া আলম
Discussion about this post