পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন আজ থেকে ৫৮ বছর আগে। তবুও প্রতিবছর কালীপুজোর দিন যেন নতুন করে জীবন ফিরে পান পান্নালাল ভট্টাচার্য। জীবদ্দশায় একের পর এক শ্যামাসঙ্গীত দিয়ে বাংলার মানুষকে মাতিয়ে রেখেছিলেন এই শিল্পী। তাঁর গাওয়া ‘আমার সাধ না মিটিল’, ‘তিলেক দাঁড়া ওরে শমন’, ‘ওপার আমায় হাতছানি দিয়ে ডাকে’-র মত গান শুনলে ভক্তিপ্রাণ বাঙালির চোখে জল আসতে বাধ্য। তবে, এত মানুষের মনের মণিকোঠায় রাজত্ব করলেও, এই মানুষটার জীবনে সুখের অনুপ্রবেশ ঘটেনি কোনোদিন। বলতে গেলে তার শেষ জীবনটা কেটেছে পুরোটা শ্মশানেই। সেখানেই মাত্র ৩৬ বছর বয়সে আত্মহত্যা করেছিলেন পান্নালাল। কিন্তু কিসের খোঁজে তিনি রোজ ছুটে যেতেন শ্মশানে? কেনো নিজের জীবনকে শেষ করেছিলেন পান্নালাল? মা কালীর দেখা পাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় নাকি কোনো অবসাদ গ্রাস করেছিল তাঁকে?
বাংলার শ্যামাসঙ্গীতের জগতে পান্নালাল বহুমূল্য রত্ন পান্নার মতই সদা উজ্জ্বল। তবে, শ্যামাসঙ্গীত দিয়ে জীবনের শুরু করতে চাননি পান্নালাল। আধুনিক গান গাওয়ার ইচ্ছে ছিল। স্বপ্ন দেখতেন, একদিন টলিউডের মস্ত বড় গায়ক হবেন। তখন বাংলা আধুনিক গানের স্বর্ণযুগে শচীন দেব বর্মন, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়দের বিরাট নামডাক। ফলে খুব একটা সুবিধা হয়নি সেদিকে। অন্যদিকে, পাঁচের দশকের পর ভক্তিগীতিতে নতুন শিল্পীর প্রয়োজন। তাই দাদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্যের হাত ধরে পান্নালাল পৌঁছে যান রেকর্ড কোম্পানির স্টুডিওতে। বাংলা সিনেমায় গান করার সমস্ত মোহমায়া ত্যাগ করে নিজের কন্ঠে ধারণ করেন মায়ের গান।
শাক্ত ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম, ফলে প্রথম থেকেই পান্নালালের শরীরে ছিল ভক্তিরসের ধারা। ছোট থেকেই দেবতাদের নাম-মাহাত্ম্য শুনতে শুনতে বড় হওয়া পান্নালালের। তবে ভক্তিগীতির ধারা বাড়িতে শুরু করেছিলেন তাঁর দাদা ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য। তাঁকে দেখেই ভক্তিগীতি শুরু পান্নার। পান্নালাল মনে করতেন, তাঁর মেজদার থেকে ভালো শ্যামাসঙ্গীত কেউ গাইতে পারেন না। আবার, ধনঞ্জয় বলতেন, “এত গান গেয়েও পান্নার মত নাড়ি ছেঁড়া মা ডাক ডাকতে পারলাম কই!”
তবে, পান্নালাল কখনোই নিজের গান নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারেননি। ধনঞ্জয় ভট্টাচার্য একবার স্বপ্নে মায়ের দর্শন পেয়েছিলেন। কিন্তু, পান্নালালের সঙ্গে কখনোই এরকম ঘটনা ঘটেনি। প্রতিবছর কালী পুজোয় দক্ষিণেশ্বরে অনুষ্ঠান করার পর সেখানেই সারারাত কাটাতেন তিনি। তবুও তিনি কোনদিন মাকে দেখতে পাননি। আর এই যন্ত্রনাই তাকে ভেতর থেকে কুরে কুরে খেতে শুরু করে।
আস্তে আস্তে সংসারের বন্ধন ছিঁড়ে শ্মশানবাসী হয়ে উঠতে শুরু করেন পান্নালাল। মাকে পেতেই হবে এই লক্ষ্য নিয়ে জীবনের শেষ দিকে সংসার ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নেন পান্নালাল। মাকে একবার দেখার সেই আকুতি বারবার তার গানে ফুটে উঠেছে। অবশেষে এল অভিশপ্ত সেই ১৯৬৬, মাত্র ৩৬ বছর বয়সে দেবী দর্শন করতে না পারার অবসাদ এবং অতৃপ্তি নিয়ে আত্মহত্যা করলেন পান্নালাল ভট্টাচার্য। হয়তো তিনি তাঁর ‘মা ভবতারিণী’কে বলতে চেয়েছিলেন, যদি তিনি তাঁর কাছে না আসেন, তাহলে তিনি নিজেই তাঁর কাছে যাবেন।
Discussion about this post