ছোটবেলা থেকেই একবার মাত্র গান শুনেই হুবহু নিখুঁতভাবে তুলে ফেলতে পারতেন সেই গানের কথা, সুর। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের কাছে গান শিখেছেন। গানের সুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে শহরময়। যোগ দিয়েছেন স্বাধীনতা আন্দোলনে। প্রতি বাঁকে পরিবর্তিত হয়েছে জীবনের গতি। পরবর্তী জীবনে ঢুকে পড়েছেন সাহিত্যের জগতে। এখানেও তাঁকে টেক্কা দেওয়া যায়নি। বিশ শতকের একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রাবন্ধিক, ঔপন্যাসিক এবং ছোটগল্পকার হিসেবে তাঁকে আজও আমরা চিনি। তিনি প্রতিভা বসু।
প্রতিভা বসু ১৯১৫ সালে অবিভক্ত বাংলার ঢাকা শহরের বিক্রমপুরে জন্মেছিলেন। তখন তাঁর নাম ছিল রাণু সোম। বাবা-মা আশুতোষ সোম ও সরযূবালা সোম কখনও কিছুতেই বাধা দেননি। পাড়া-প্রতিবেশী, সমাজের নিন্দাকে আমল না দিয়ে তাঁরা মেয়েকে দিলীপকুমার রায়, হিমাংশু দত্ত, নজরুল ইসলাম, চারুদত্ত, মেহেদি হোসেন, ভোলানাথ মহারাজ, প্রফেসর গুল মহম্মদ খাঁর মত ওস্তাদদের কাছে কাছে শিখতে পাঠিয়েছিলেন। চোঙওয়ালা কলের যন্ত্রে তাঁর গান শোনানো হলে ‘ছি ছি’ রব পড়ে গিয়েছিল। ‘বাড়ির মেয়েরা’ বাড়ির ভিতরেই কথা বলেনা, তার গান নাকি দুনিয়ার লোক শুনছে! দুই বাংলাতেই রাণু সোমের নাম ছড়িয়ে গেলেও, বাড়িতে কিন্তু রেওয়াজ করতে বসতে হত জানলা-দরজা বন্ধ করে। ততদিনে আবার বিপ্লবী লীলা নাগের হাত ধরে স্বাধীনতা সংগ্রামেও যুক্ত হয়েছেন রাণু সোম।
চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার দখলের অন্যতম নায়ক অনন্ত সিংহের ফাঁসির আদেশ হয়েছিল। ফাঁসি রদের মামলা চালানোর জন্যে দরকার অর্থ। গান গেয়ে সেই অর্থের যোগান দিয়েছিলেন প্রতিভা সোম। ফাঁসির আদেশ রদ হয়েছে। বিপ্লবী লীলা নাগের ব্যক্তিত্ত্ব প্রতিভাকে এতটাই প্রভাবিত করেছিল, যে পরবর্তীতে তাঁর উপন্যাসের চরিত্রের মধ্যেও লীলা নাগের ছাপ পাওয়া যায়। এর মধ্যে রাণুর আলাপ হয়েছে কবি বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে। তারপরে বিয়েও করেছেন কবিকেই। নাম হয়েছে প্রতিভা বসু। গান ছেড়ে মন দিয়েছেন সাহিত্যচর্চায়। সারাজীবনে লিখেছেন উপন্যাস, ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, স্মৃতিকথা, আত্মজীবনী। পেয়েছেন লীলা পুরস্কার, আনন্দ পুরস্কার, জগত্তারিণী গোল্ড মেডেল। তাঁর গল্প-উপন্যাস অবলম্বনে বাংলা ও হিন্দিতে সিনেমাও হয়েছে।
প্রতিভা বসুর চরিত্ররা, আশাপূর্ণা দেবীর ‘সুবর্ণলতা’র মতো নয় বা সমসাময়িক সাবিত্রী রায় বা সুলেখা সান্যালের মতো প্রতিবাদী ধাঁচারও নয়। তাঁর চরিত্ররা শিক্ষিত, নাগরিক আধুনিকতায় মোড়া মধ্যবিত্ত। তাঁর নিজের জীবনেও এই আধুনিকতার প্রকাশ ঘটেছে। সে সময় পুরুষ একা শহরে বাসা খুঁজতেন, পরে স্ত্রীকে গ্রাম থেকে নিয়ে আসতেন। অথচ প্রতিভা দেবী স্বামীর সঙ্গে মিলে কলকাতা শহরে বাড়ি খুঁজে বেড়িয়েছেন, সঙ্গী কবি সমর সেন। প্রতিভা বসু তাই শুধু নারী স্বাধীনতা বা জনপ্রিয় গল্পের রূপকার নন। বুদ্ধদেব বসুর সহধর্মিণীও তাঁর পরিচয় নয়। তিনি বাঁধা গতের বাইরে নারীর স্বতন্ত্র আধুনিক রূপ।
Discussion about this post