আমাদের কলকাতা কোন না কোন কারণে বিখ্যাত। ইতিহাসের পাতায় প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসাবে স্বীকৃত। ব্রিটিশ শাসনকালে খিদিরপুরের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। কারণ যোগাযাগের মাধ্যম তখন জলপরিবহণ। হুগলি নদী তখন গভীর এবং নাব্য। ব্রিটিশরা প্রভুত্ব করতে এসেছিল আমাদের দেশে প্রথমে সাগর পথে, তারপর হুগলী নদী পথে। শেষে নোঙর করে এই খিদিরপুরের ঘাটে। তাই এখানে আনাগোনা ছিল নাবিক আর মাঝিমাল্লাদের, সঙ্গে ব্রিটিশ নৌসেনারও। তাদের জন্যই গড়ে ওঠে কবরখানা। নৌসেনার স্মরণে লস্কর ওয়ার মেমোরিয়াল।
তবে সবার আগে দেবতার আশ্রয়, যেখানে সবাই প্রার্থনা করেন। কিনারার সন্ধান করতে আসা জলযান দূর থেকে দেখতে পায় দেবতার আলয়, সেন্ট স্টিফেন্স চার্চ। বাতিঘর হয়ে জাহাজীদের ডাক দিত এই অ্যাংলিকান চার্চ। ৬ জানুয়ারি, ১৮৪৪ সালে আর্চডিকন টমাস ডেলট্রির সহযোগিতায় গভর্নর জেনারেল এডওয়ার্ড ল এটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ৩ নং ডায়মন্ড হারবার রোডে, খিদিরপুরের সেন্ট টমাস বয়েজ স্কুলের পাশটিতে এই ছোট্টখাট্টো কিন্তু অনন্য দর্শন চার্চটি পাঁচিলের ঘেরাটোপে দাঁড়িয়ে। সামনে অনেকতা সবুজ ঘাস জমি। চার্চটি গথিক স্থাপত্য রীতি অনুসরণে তৈরী। সামনে পিনাকল সহ একটি উঁচু মিনারের মত বেল টাওয়ার। দোতলা লেভেলে চারদিকে গথিক জানলা, তাতে খড়খড়ি লাগানো কাঠের পাল্লা। টাওয়ারের দুপাশে বাট্রেসের মত দুটি প্রোজেক্টেড দেওয়াল।
প্রথমে এটি শুধু গভর্নর জেনারেল ও তাঁর পরিবারের প্রার্থনার জন্যই ব্যবহৃত হতো। পরে ১৮৭০ সালে সাধারণের জন্য খুলে দেওয়া হয়। চার্চে নাবিক, জাহাজী ছাড়াও আসতেন স্থানীয় ইংরেজ এবং প্রচুর বাঙালি, যাঁরা ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর বহু ইংরেজই নিজের দেশে পা বাড়ালেন। যাত্রীবাহী জাহাজও আর ভেড়ে না খিদিরপুর ডকে। চার্চের গুরুত্ব ফুরল। আটের দশকে চার্চ বন্ধই হয়ে গেল। সে বেঁচে রইল ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত ১৮৫১ সালে ফ্রেডরিক ফিবিগের দক্ষিণ-পশ্চিম দিক থেকে তোলা এক রঙিন ফোটোগ্রাফে। লাইব্রেরির অনলাইন গ্যালারিতে খুঁজলে পাওয়া যাবে সে ছবি। ২০১৩ সালে নতুন উদ্যমে শুরু হয় চার্চের পুনরুজ্জীবন। অর্থ সংগ্রহের জন্য সোশ্যাল মিডিয়ায় আবেদন রাখা হলো, পাঁচশো টাকা মূল্যের প্রতিটি ইটের গায়ে লেখা থাকবে দাতার নাম। ধীরে ধীরে ছিমছাম ছোট্ট চার্চ আবার আগের মতই সেজে উঠল। যদিও মেঝের মূল মার্বেল পুনঃসংস্থাপিত করা সম্ভব হয় নি। বর্তমানের মেঝেটির মার্বেল দান করেন চার্চের এক সদস্য তাঁর অকালমৃত শিশুপুত্রের স্মরণে।
আসলে কলকাতার প্রতিটা অঞ্চলের ঐতিহাসিক আভিজাত্যের মহিমা আমাদের বিস্মিত করে রাখে। কলকাতার নানা ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে গির্জাগুলো। আমরা যখন সেই তথ্য খুঁজে পাই তখন কত শত ঘটনার ঘনঘটা আড়াল থেকে উুঁকি দেয়।
Discussion about this post