মেয়েটির মায়ের অপারেশন। যে সে অপারেশন নয়, একেবারে পেসমেকার বসবে। সময়টাও এই সময় নয়, কয়েক দশক আগের ঘটনা। যেদিন অপারেশন, সেইদিনই মেয়েটির নাটকের ডবল ‘শো’! মেয়েটি অভিনয় করবে দ্বৈত চরিত্রে, তার একটি পুরুষ, অন্যটি নারী! এ কি অসম্ভব ব্যাপার! কিন্তু মেয়েটি অভিনয় করল। মায়ের অপারেশনের শেষে বিধ্বস্ত হয়ে সে যখন রঙ্গমঞ্চে এল, তখন নাটকের প্রথম বেল বেজে গেছে। সকলের মুখে অবিশ্বাস। কিন্তু তিনি অভিনয় করলেন, কুড়োলেন প্রশংসা! তিনি কেয়া চক্রবর্তী।
উত্তর কলকাতায় জন্ম নেওয়া কেয়া, স্কটিশে ইংরেজি সাহিত্যের মেধাবী ছাত্রী ছিলেন। ওই কলেজেই অধ্যাপনাও করেছেন পরে। থিয়েটারে যুক্ত সেই কলেজ জীবন থেকেই। অভিনয় করতেন ‘নান্দীকার’এ। ‘শের আফগান’, ‘নটী বিনোদিনী’, ‘ভালোমানুষ’, ‘তিন পয়াসার পালা’ প্রভৃতি প্রযোজনায় তিনি থাকতেন প্রধান চরিত্রে। তাঁর অভিনয় প্রতিভা ছিল বহুমুখী। সর্বতভাবে প্রশংসা পেয়েছেন দর্শকদের থেকে। তিনি বলতেন, ভালো মানুষ না হলে ভালো থিয়েটার করা যায়না। কেউ তাঁকে কখনও ক্লান্ত হতে দেখেনি।
পুরুষের চরিত্রে দক্ষভাবে অভিনয়ের জন্য তিনি শাড়ির সঙ্গে বুট জুতো পরে অধ্যাপনার কাজে যেতেন। পারিপার্শ্বিক সমাজ, মানুষ তাঁকে বিচলিত করেনি কখনও। আজ এতবছর পরেও যখন নারীর পোশাক নিয়ে, আচরণ নিয়ে, কথা নিয়ে কথা হয়, নারী সঙ্কুচিত হয়ে থাকে, সেখানে অত বছর আগেও কেয়া চক্রবর্তীকে থামিয়ে রাখা যায়নি। শিল্পের জন্য, থিয়েটারের জন্য তিনি নাকি নিজের বিয়ের গয়না বেচে নাটকের দলকে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন। অধ্যাপনা ছেড়ে দেওয়ার পর অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি জুতোর কোম্পানির বিজ্ঞাপনের কপি লিখে নিজের ভরণপোষণ করতেন।
আজ এই উত্তাল সময়ে, যেখানে মেয়েরা এবং প্রান্তিকলিঙ্গগোষ্ঠীর মানুষেরা জেগে উঠেছেন, রাস্তায় নেমেছেন, প্রতিবাদে সোচ্চার হচ্ছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। আর সেই সময় কেয়া চক্রবর্তী নীরবেই যেন প্রতিবাদ করে গেছেন, তাঁর জীবনযাত্রা দিয়ে, তাঁর কাজ দিয়ে, তাঁর সাহস দিয়ে। তাঁর মৃত্যুটিও যেন ছিল নাটকের স্ক্রিপ্টের মতই। আসলে কীভাবে তাঁর মৃত্যু হয়েছিল, তা সঠিক জানা যায়না। জল থেকে তাঁর দেহ পাওয়া যায়, শরীরে আঘাতের চিহ্ন। তাঁর জীবনবোধ ছিল ব্যাতিক্রমী। কবিতা সিংহ বলেছিলেন, “এই জীবনবোধ সাধারণত কোনো বাঙালি মেয়ের হয়না।”
 
	    	 
                                





























 
		    








Discussion about this post