প্রাচীন ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরেই, আমরা আমাদের মতো করে বাঁচিয়ে রাখব এক ভিন্ন সভ্যতাকে। পৃথিবীর অন্যতম উন্নত দেশ ইতালির এক প্রান্তিক গ্রাম। তবে মাতৃভাষা ভিন্ন| যেন এক বিচিত্র রহস্য লুকিয়ে রয়েছে গোটা প্রদেশ জুড়ে। এক নয় একাধিক ভাষায় সমৃদ্ধ ভারত সহ গোটা এশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, আফ্রিকা এবং উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার অনেকাংশ। তবে ইউরোপ মহাদেশ মূলত কথ্য ভাষা এবং সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করেই সেই বৈচিত্র থেকে নিজেকে ভিন্ন করে রেখেছে। তবে ব্যতিক্রম রয়েছে এই যে, ইতালির বুকে দন্ডায়মান এমনই একটি গ্রাম কম্বাসকুরো। খুবই ছোট্ট এই গ্রাম, যেখানকার বাসিন্দাদের মাতৃভাষা বা কথ্য ভাষা ইতালিয়ান নয়। এমনকি গোটা গ্রাম জুড়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতির চর্চা হয়।
ইতালির এই রহস্যময়ী ছোট্ট গ্রাম যেন সম্পূর্ণ পৃথক এক প্রদেশ, যার ডাকনামও ‘লিটল প্রোভিন্স’ বা ‘বিচ্ছিন্ন প্রদেশ’। প্রায় তিরিশ জন মানুষের বসবাস এই গ্রামে। এছাড়াও হাতে গোনা কিছু মেষপালকও রয়েছে। প্রচলিত ভাষা ‘প্রোভেনসাল’, যা ,একধরনের মধ্যযুগীয় নব্য-ল্যাটিন ভাষা। তবে কম্বাসকুরোতে যাওয়ার পথ কঠিন তো বটেই। তুরিন থেকে বিমানে করে তারপর রেল এবং সড়কপথে যাত্রা করার পর দীর্ঘ কয়েক মাইল ট্রেকিংয়ের পর চোখে পড়ে ধূ ধূ সবুজ প্রান্তরে মোড়া রহস্যময়ী প্রান্তিক গ্রাম। তার বুকে অবিন্যস্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে কাঠ ও পাথরে নির্মিত ছোট ছোট ঘর-বাড়ি। এখানে মোবাইল ফোনের টাওয়ার কিংবা ইন্টারনেট পরিষেবা মেলা তো দুষ্করই এমনকি অধিকাংশ দিনই বিদ্যুৎ সংযোগ থাকে না। ইউরোপ মহাদেশের বুকে এমন প্রত্যন্ত গ্রাম থাকতে পারে তা ভাবনীয়।
একুশ শতকে দাঁড়িয়ে কেন ইতালির সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন এই গ্রাম এরই উত্তর খুঁজতে হলে ফিরে যেতে হবে ত্রয়োদশ শতকের শেষের দিকে। সেই সময়েই ইতালির এই প্রাগৈতিহাসিক গ্রামে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। জনবসতি খুব একটা বেশি ছিল বলাটা ভুল হবে আবার খুব কমও ছিল না। ফ্রান্সের অক্সিটোনয়া অঞ্চল থেকে মানুষরা এখানে এসে বসতি স্থাপন করলেও অধিকাংশ মানুষই এখানকার আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেননি। কথিত রয়েছে, শীতকালে এখানকার তাপমাত্রা আকস্মিকভাবে কমে যাওয়ার দরুণ বছরের এই সময়টায় অন্যত্র চলে যেতেন অধিকাংশ বাসিন্দাই। আবার যুদ্ধের ছায়া থেকে নিস্তার পেতে প্রায় অধিকাংশ মানুষই বিদায় জানিয়েছেন এই গ্রামকে। কখনও এই প্রান্তিক গ্রামটি গিয়েছে ইতালির দখলে আবার কখনও বা গেছে ফ্রন্সের দখলে। সুতরাং ইতালি ও ফ্রান্সের দ্বন্দে বার বার সীমারেখাও পরিবর্তিত হয়েছে এই গ্রামের। সেই কারণেই ইতালিয়ান ও ফরাসির বাইরে ভিন্ন এক কথ্য ভাষাকে মাতৃভাষা করে নিয়েছে এই প্রত্যন্ত গ্রাম|
বিশ শতক শুরু হতে না হতেই গ্রামের জনসংখ্যা প্রায় একশোর নীচে নেমে গিয়েছিল। নামতে নামতে বর্তমানে সেই জনসংখ্যা এসে দাঁড়িয়েছে তিরিশে। এখনও প্রাচীন ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতিকে আঁকড়ে ধরেই বেঁচে আছেন তারা এবং তাদের সাথে বাঁচিয়ে রেখেছেন ভিন্ন এক সভ্যতাকে। যা এক জীবন্ত ইতিহাসের চিত্রিত রূপ।
প্রতিবেদক বিনীতা দাস
Discussion about this post