দেবী দুর্গা হলেন স্বয়ং ‘শতরূপা’। কখনও তিনি সিদ্ধিদাত্রী,কখনও তিনি দেবী চন্ডী। আবার কোথাও তাঁর একান্তই লৌকিকরূপ। যেমন কোচবিহার রাজবাড়িতে তিনি পূজিতা ‘বড়দেবী’ রূপে। তাঁর গাত্রবর্ণ অতসী ফুলের ন্যায় পীত বর্ণ নয়, বরং তিনি এখানে রক্তবর্ণা। এখানে দেবীর দু পাশে থাকেন না তাঁর চার সন্তান। পরিবর্তে তিনি এখানে হাজির তাঁর দুই সখী ,জয়া ও বিজয়াকে নিয়ে। সিংহের পাশাপাশি এখানে তাঁর বাহন বাঘও।
বড়দেবীর আরাধনার সূচনা দেবীপক্ষ সূচনার অনেক আগে থেকেই। শ্রাবণের শুক্লা অষ্টমী তিথিতে সংগ্রহ করা ময়না কাঠ আনা হয় কোচবিহার ডাঙ্গরাই মন্দিরে। সেখানে সম্পন্ন হয় ময়না কাঠের মহাস্নান। একমাস ধরে নিয়মিত বিশেষ পুজো চলে ময়না কাঠের। এই ময়না কাঠ দিয়েই তৈরি হবে বড়দেবীর মূল কাঠামো। রাধাষ্টমী তিথিতে সেটিকে নিয়ে আসা হয় বড়দেবীর মূল মন্দিরে। সে খানেও মহাস্নান সম্পন্ন হলে শুরু হয় পুজো। তিন দিন ধরে ময়না কাঠটিকে হাওয়া খাওয়ানোর পুরোনো নিয়ম রয়েছে। তারপরই শুরু হয়ে যায় বড়দেবীর প্রতিমা নির্মাণ।
শুধু ময়না কাঠই কেন? এই প্রশ্ন মনে আসা স্বাভাবিক। তবে উত্তরের জন্য উঁকি দিতে হয়,৫০০ বছর আগের ইতিহাসের পাতায়। কোচ রাজবংশের মহারাজা বিশ্বসিংহ বাল্যকালে বন্ধুদের সঙ্গে খেলার ছলে একটি ময়না গাছকে দেবী দুর্গা হিসেবে পুজো করেন। এই গাছের সামনে হাড়িকাঠে বাঁধা পাঠার ন্যায় সাজিয়ে রাখা বন্ধুকে সামান্য কুশ দিয়ে গলায় আঘাত করতেই তাঁর ধড়-মুন্ডু আলাদা হয়। পরবর্তীতে বিশ্বসিংহ কোচবিহারের রাজা হলে দেবী দুর্গা রূপে ময়না কাঠের পুজোর প্রচলন করেন।
তবে বড়দেবীর বর্তমানের বিশেষ রূপে পুজোর সূচনা রাজা নরনারায়ণের আমলে। তাঁর স্বপ্নে দেবী যে রূপে ধরা দিয়েছেন সেই রূপেই গড়ে তোলা হয় মৃন্ময়ী অবয়ব। কথিত আছে রাজা,রাজা নরনারায়ণের ভাই বীর চিলা রায় ছিলেন তাঁর প্রধান সেনাপতি। কার্যত তিনি সামলাতেন রাজপাটের সিংহভাগ দায়িত্ব। চিলা রায়ের একদিন হঠাৎই খেয়াল হয়, সিংহাসনের দায়িত্ব তাঁর পাওয়া উচিত। তিনি রাজার ঘরে চুপিচুপি হামলা দেন রাজাকে হত্যার উদ্দেশ্যে। কিন্তু ঘরে গিয়ে তিনি সততই নির্বাক। এ কী! রাজাকে আগলে রেখেছেন স্বয়ং মহামায়া! তিনি আর এগোতে পারেননি সেদিন।
পরে আবারও একদিন উদ্যোগ নেন নরনারায়ণকে হত্যা করবার। পুনরায় একই দৃশ্য। দশ হাতে রাজা নরনারায়ণকে রক্ষা করছেন দেবী! চিলা রায় নিজের ভুল বুঝতে পারেন। দাদার পদযুগলে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।তিনি দাদাকে জানান, স্বয়ং মহামায়া যাঁকে আগলে রেখেছেন, তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা মহা নির্বুদ্ধিতার পরিচয়। এই কথায় দাদা নরনারায়ণ তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে জানান, আসলে তিনিই সৌভাগ্যশালী। অন্তত দেবী মা তাঁকে দর্শন দিয়েছেন! রাজা নরনারায়ণের এখনো সেই সৌভাগ্য হয়নি। সেই রাতেই দেবী মা তাঁর স্বপ্নে হাজির হন রক্তবর্ণা রূপে।
তবে একসময় প্রচলিত নরবলি রাজা নরেন্দ্রনারায়ণ বন্ধ করে দেন। কিন্তু মাকে আজও উৎসর্গ করা হয় নররক্ত। মহাষ্টমীর মহানবমীর সন্ধিলগ্নে চলে গুপ্ত পুজো। সাধারণ মানুষের থাকা সেখানে নিষিদ্ধ। কামসানাইট উপাধিকারী এক বিশেষ পরিবারের সদস্য পুরুষরাই আঙ্গুল কেটে কয়েক ফোঁটা রক্ত দেন দেবীর উদ্দেশ্যে। তবে এখনো অষ্টমীতে প্রচলন আছে মহিষ বলি। দশমীর সকালে মায়ের বিসর্জন। দেবী প্রতিমা কুড়ুল দিয়ে টুকরো করে বিসর্জন দেওয়া হয় যমুনা দীঘির জলে। অপেক্ষা আবারো এক বছরের। পুজোর গন্ধ আবার কবে এই অপেক্ষাতেই শুরু হয়ে যায় উল্টো গুনতি।
Discussion about this post