ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া যেমন বাংলাদেশকে কল্পনা করা যায় না, তেমনি এই বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোও ভাবা যায় না। কারণ মুক্তিযুদ্ধের প্রতি ক্ষেত্রেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের কোনো না কোনো অবদান রয়েছে। স্বাধীনতার লড়াইয়ে সবরকমভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে গেছে। বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীন পতাকার স্বপ্ন দেখতে শিখিয়েছিল এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
আর্থ-সামাজিক নানা সংকটেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধেও এই বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশকে পথ দেখিয়েছে। ৭১-এর মার্চ মাস ছিলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে উত্তাল ও ঘটনাবহুল। বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলে ১ মার্চ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠন সম্পূর্ণ স্থগিত হয়ে যায়। শিক্ষার্থীরা অস্ত্র লুঠ ও অস্ত্র প্রশিক্ষণে যুক্ত হয়। সারা মার্চ মাস জুড়ে নানারকম ঘাত-প্রতিঘাত, আন্দোলন, প্রতিরোধের পর আসে ২৫ মার্চ। সেই রাত বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে আজও ‘কাল রাত’ হয়ে আছে।
যারা যতো বেশি সক্রিয়, তাদের ওপর আঘাতও নেমে আসে ততো বেশি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও তার ব্যতিক্রম ছিল না। বাঙালীর স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমন করতে জুলফিকার আলি ভুট্টো ও ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে পাকবাহিনী ‘সার্চলাইট অপারেশন’ নামের নৃশংস গণহত্যা শুরু করে। তা শুরু হয় আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ওই রাতে নিরস্ত্র ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর ভয়াবহ আক্রমণ চালিয়েছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, কর্মচারী, মালি, পিওন কাউকে রেহাই দেয়নি তারা। হানাদার বাহিনীর অপারেশনের প্রথম লক্ষ্য ছিল ইকবাল হল (বর্তমানে জহুরুল হক হল)। শুরু হয় এলোপাথাড়ি গুলিবর্ষণ। তারপর একে একে হামলা চলে জগন্নাথ হল, সলিমুল্লাহ হল, রোকেয়া হল এমনকি শিক্ষক-কর্মচারীদের কোয়ার্টারেও।
শোনা যায় শুধু জহুরুল হক হলেই প্রায় ২০০ ছাত্রের প্রাণ হারায়। রোকেয়া হলে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় এবং ছাত্রীরা দৌড়াদৌড়ি করে বের হওয়ার সময় মেশিনগান দিয়ে তাদের ওপর গুলি চালানো হয়। গোবিন্দচন্দ্র দেব, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, সরাফত আলী সহ আরও প্রথিত যশা শিক্ষক ওই রাতে নিহত হন। সবমিলিয়ে প্রায় ৩০০ ছাত্র-ছাত্রী, ৯ জন শিক্ষক ও বহু কর্মচারী নিহত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে, নেমে আসে নীরবতা। এই ভয়াবহতা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। কিন্তু তারপরও স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিরত রাখা যায়নি। বাংলাদেশের সবুজ জমিতে লাল সূর্য ওঠানোর স্বপ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কতো ছাত্র-শিক্ষকের যে প্রাণ গেছে তার হিসেব নেই। একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুধু জ্ঞানচর্চায় আবদ্ধ না থেকে গোটা দেশ- জাতির সংকটে সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে লড়ে আজও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বাধীন বাংলাদেশের রূপকার বললেও বোধহয় ভুল হবে না।
Discussion about this post