শিয়ালদা স্টেশনের কাছে রয়েছে একটি বিখ্যাত বাজার, যার নাম কোলে মার্কেট। বি বি গাঙ্গুলি স্ট্রিটের ওপরে অবস্থিত এই বাজারের মধ্যেই আছে একটি ক্যাথলিক চার্চ, যার নাম Church Of Our Lady Of Dolours. এটি একটি পর্তুগিজ চার্চ এবং সেই ভাষায় এর নাম হল NOSSA SENHOVA DES DORES. মিসেস গ্রেস এলিজাবেথ নামে একজন ধনী ক্যাথােলিক বিধবা ভদ্রমহিলা ১৮০৮ খ্রিস্টাব্দে বৈঠকখানা অঞ্চলে এই গির্জা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেন। এই উদ্যোগে তাকে সাহায্য করেন চার পর্তুগিজ ভদ্রলোক – দিয়েগাে প্রেইরা, জোসেফ প্রেইরা, ফিলিপ লিস, এবং চার্লস কর্নেলিয়াস। গির্জার নির্মাণ শেষ হয় ১৮০৯ খ্রিষ্টাব্দে এবং উদ্বোধন হয় তার পরের বছর।
গির্জাটি উৎসর্গ করা হয়েছিল শােকাতুরা মাদার মেরির প্রতি। যীশু ক্রুশে প্রাণদানের পর, মাদার মেরির যে শােক… তারই ভাবনা প্রতিফলিত হয় গির্জার নামে। বলতে গেলে, মাদার মেরির স্মরণে কলকাতায় এটিই হল সর্বপ্রথম গির্জা। এছাড়াও অবিভক্ত বঙ্গদেশে এই গির্জাতেই প্রথম বাংলা-ভাষায় প্রার্থনা পরিচালিত হত। গ্রেস এলিজাবেথ খ্রিস্টান বালক-বালিকাদের মধ্যে আধুনিক শিক্ষা প্রচারের জন্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সেন্ট ক্রিসােসটমস বিদ্যালয় (St. Chrysostom’s)। এই কাজে তাকে সাহায্য করেছিলেন এই গির্জার প্রথম পুরোহিত অগাস্টানিয়াম সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের ফ্রায়ার এন্টনিও ডি’ পাদুয়া (১৭৭৩-১৮১০)। এখানে বাইবেল ছাড়াও ইংরেজি, গণিত ও পর্তুগিজ শেখানাে হত। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য, এই স্কুলের সূত্র ধরেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল আজকের সেন্ট লরেন্স ও সেন্ট ইনিস স্কুল দুটি।
এলিজাবেথ গ্রেস চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ছিলেন পর্তুগিজ এবং মা ভারতীয় নারী। ওই সময় চট্টগ্রাম পর্তুগিজদের এক বিশিষ্ট কেন্দ্র ছিল। ২২.৫.১৮১৮ তারিখে তিনি কোলকাতায় মারা যান, এবং তাকে এই চার্চের পিছনেই সমাধিস্থ করা হয় (সেই সমাধিটি কিন্তু এখন আর খুঁজে পেলাম না, সেখানে বাগান হয়ে গিয়েছে)। সমাধির বুকে মর্মরফলকে পর্তুগিজ ভাষায় তার জীবনের সংক্ষিপ্ত বিবরণ লেখা রয়েছে। অকাল বৈধব্যের বেদনায় তিনি ছিলেন ভারাক্রান্ত। এ কারণেই সম্ভবত শােকার্ত মাতা মেরির ভাবনা এসেছিল তার এ গির্জার নামের পরিকল্পনায়। গির্জাটির উত্তর প্রান্তে রয়েছে একটি বেদি, তার নিচে মাদার মেরি ও ডানপাশে যিশুর একটি ছবি রয়েছে। গির্জায় রয়েছেন Our Lady of Success, যিনি ভারতীয় পােশাক শাড়িতে সজ্জিতা। দেওয়ালের গায়ে অন্যান্য রােমান ক্যাথােলিক গির্জার মতাে এখানেও station of the cross পর্যায়ের, ১৪ টি বর্ণময় চিত্রে যিশুর শেষ জীবনের উপর আধারিত এক প্রদর্শনী সাজানাে হয়েছে।
পুরো চার্চের দেওয়ালের নানান অংশে লাগানাে রয়েছে নানা স্মৃতিফলক। সবই পর্তুগিজ ভাষায়। একখানি স্মৃতিফলক রয়েছে, যা গঠনের জন্য বিশেষভাবে নজরে পরে। পাথুরে অলংকরণের ওপরে লেখা রয়েছে VIAYANTE, যার মানে হলো The Traveller. স্মৃতিফলকটা পড়তে পারি নি ভালো করে, কারণ তা পুরোনো ধাঁচের পর্তুগিজ ভাষায় লেখা। নিচের দিকে স্মারকটির ভার রাখা আছে দু’পাশে দুটি সিংহ মূর্তির উপর, মাঝের অংশে আড়াআড়িভাবে দুটি মানব অস্থির ওপর একটি করােটি। সেন্ট রক (পিটার) ও সেন্ট ফ্রান্সিস জেভিয়ারের মূর্তিসহ, সেন্ট অ্যানি ও শিশু মেরির সঙ্গে সাজানাে এক দিকে। এছাড়াও গির্জার দেওয়ালে ছড়িয়ে আছে খ্রিস্টধর্মীয় নানা বর্ণময় চিত্রমালা। প্রতি রবিবার এখানে বাংলাভাষায় প্রার্থনা পরিচালনা করেন দক্ষিণ ভারতীয় পুরােহিত। বলতে গেলে, কোলে মার্কেটের মতো ঘিঞ্জি এলাকায় এই চার্চটি মরুদ্যানের মতো।
Discussion about this post