ওরা কাঁটাতার মানে না। গোটা আকাশটা জুড়েই আপন মনে উড়ে বেড়ায়।তাই সাত-সমুদ্র তেরো নদী পার করে পূর্বস্থলিতে চুপি চুপি আনাগোনা। বিদেশিরা প্রতিবারই আসে, তবে চুপি চুপি কেন? বর্ধমান জেলার নিকটবর্তী পূর্বস্থলি স্টেশন থেকে ৫ কিমি দুরত্বে জায়গাটার নাম ই ‘চুপির চর’। ‘চুপি কাষ্ঠশালী পাখিরালয়’ নামেও পরিচিত।
ভাগীরথীর অন্যতম একটি শাখা যা অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ হয়ে গঙ্গা বক্ষে মিশেছে। গ্রাম বাংলার সেই হ্রদই পর্যটন কেন্দ্র। শান্ত নদী, একেবারে স্রোতহীন মনোরম পরিবেশ। হ্রদের জল স্ফটিকের ন্যায় স্বচ্ছ,সবুজ জলজ উদ্ভিদের দেখা মেলে নৌকা থেকেই। পাখির কুজন আর মাঝির দাঁড় টানার শব্দ জায়গাটিকে দারুণ মাতিয়ে রেখেছে। বছর দশেক পর্যটক স্থান হিসাবে গড়ে উঠলেও মূলত: তিন চার বছর বিশেষ পরিচিতি লাভ করেছে। গঙ্গার একপ্রান্তে কুয়াশায় ঢাকা মায়াপুর মন্দির, অপর প্রান্তে সবুজ কচুরিপানায় মোড়া এই হ্রদ। প্রকান্ড আমবাগান, চারটি কটেজ, দুটি গেস্ট হাউস আপাতত তৈরি। পর্যটকদের সর্বদা আহ্বান জানাতে প্রস্তুত নিবিড় গ্রাম্য প্রকৃতি। নৌকা করে মাঝিরা সম্পূর্ণ গাইড করে পুরো জায়গাটি ঘোরান।
কাস্পিয়ান সাগর, হিমালয়, সাইবেরিয়া, মধ্য-পূর্ব এশিয়া, তিব্বত, ইউরোপ থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করে বহু পরিযায়ী পাখি এসে ভিড় করে পূর্বস্থলিতে। শীত পড়তে না পড়তেই সরাল, বালি হাঁস, কায়েম তো আছেই। মূল আকর্ষণ হল রেড ক্রিস্টেড পচার্ড। এরা ইউরোপিয়ান। ওই দেশে শীতের হাত থেকে রক্ষা পেতে চলে আসে দলে দলে। কমলা মাথা, লাল ঠোঁট নিয়ে সদর্পে সাঁতারে চলে। এদের পুরুষ প্রজাতিরাও ডানা ঝাপটায় । এখানে আছে দুটি কালো অস্প্রে। বেশিরভাগ সময় লম্বা বাঁশের মাথায় এরা বসে থাকে। ঝাঁকে ঝাঁকে সরাল উড়ে বেড়ায়। কত রং বেরঙের পাখি খেলে বেড়ায় গ্রাম্য পরিবেশে। ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফারদের কাছে এ যেন পাখির স্বর্গ।
প্রায় প্রত্যেক শীতের শেষে, গরমের একটু আগেই ফিরে যায় বিদেশী পাখিরা। তবে মহামারীর কারণে দূষণের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে নিজেকে নতুন করে গুছিয়ে নিয়েছে। প্রকৃতিকে বন্ধু করে আরও খানিকটা তৃপ্ত করতে বেশ কিছু পরিযায়ী অতিথি রয়ে গেছে চুপির চরে। গ্রামীণ পঞ্চায়েত সহ মাঝিরাই দেখভাল করছেন অতিথিদের। মাঝি পিযুষ হালদারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, এ বছর কচুরিপানায় ভরে আছে। বিশেষ পাখি নেই। পর্যটকের আনাগোনা নেই বলে মাঝিদের আর্থিক অবস্থাও সঙ্কটময়। তবে সুসংবাদ হল নতুন ইন্টারনেট ব্যবস্থা এদেরকে কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারেনি। ভালো আছে পাখিরা, জানান স্থানীয় বাসিন্দা প্রদীপ পাড়ুই। বনলতা সেনের দারুচিনির দ্বীপের মতোই সবুজে মোড়া এই হ্রদেও পাখির নীড়েরা চোখ তুলে তাকায়।
চিত্র ঋণ – অগ্নিশ্বর ঘোষাল, সুমন বিশ্বাস, পিনাকী হালদার
Discussion about this post