১৯১৪ সাল, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সেই ভয়ঙ্কর মূহুর্ত। কামান ও গুলির ঝলকানিতে কাঁপছে গোটা বিশ্ব। জমাট বাঁধা রক্তে রাঙা ধরিত্রী। কিন্তু আচমকা একদিন বদলে গেল যুদ্ধের আতঙ্কজনক পরিস্থিতি। ব্রিটিশ আর্মির আইরিশ রাইফেলসের ক্যাপ্টেন আর্থার ও’সুলিভান তখন ফ্রান্সের রিও ডি বয়েজে। ব্যারাক থেকে জার্মান উচ্চারণে একটি বাক্য কানে আসে, ‘রাত ১২টার পরে গুলি করো না, আমরাও করব না।তোমরা ইংরেজরা যদি ব্যারাক থেকে বের হয়ে আমাদের সাথে কথা বলতে আসো, আমরা তোমাদের গুলি করব না”। এমনকি সীমান্তরেখাটি গমগম করে ওঠে দুই দলের সৈন্যদের পদচারণায়। কী এমন ঘটনা ঘটেছিল সেদিন? যুদ্ধ ভুলে কেনইবা মৈত্রীময় সুর ছিল সেদিন?
দিনটি ছিল বড়দিনের আগের রাত। বড়দিন উপলক্ষে ১৯১৪ সালের অনানুষ্ঠানিক যুদ্ধবিরতি হয়। জার্মান সৈন্যরা তখন গান গাইছে। তাদের সাথে সুর মিলিয়েছে মিত্রপক্ষের সৈনিকরাও। সুরের প্লাবনে ভাসছে তখন সীমান্ত। জার্মানরা হাতে লণ্ঠন নিয়ে ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে আহ্বান জানাচ্ছে ব্রিটিশদের। বড়দিনে শুধুই ‘মেরী ক্রিসমাস’ কথাটা বলার জন্যই তাদের স্বাগত জানায় বিরোধী দল। দু’পক্ষের লোকজন মিলিত হয়। হাত মিলিয়ে সিগারেট আর খাবার-পানীয় ভাগ করে সবাই মিলে উদযাপন করে এই যুদ্ধবিরতি। ভ্রাতৃসুলভ কোলাকুলি থেকে শুরু করে বন্দী বিনিময়ের ঘটনাও ঘটে এই বিশেষ দিনে।
জার্মানদের থেকে এমনটা ছিল অপ্রত্যাশিত। ব্রিটিশ এবং জার্মান দল মিলে প্রায় এক লক্ষ সৈন্য সেদিন ভালোবাসার হাত বাড়িয়ে দেয়। তাদের সে ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের দেশগুলোতেও। সবার উদ্দেশ্যে একটি শান্তির বার্তাবাহী চিঠি যায় ১০১ জন ব্রিটিশ নারীর কাছে। পোপ পঞ্চম বেনেডিক্ট ৭ ডিসেম্বর থেকেই যুদ্ধরত দেশগুলোর সরকারের কাছে চিঠি পাঠিয়েছিলেন। আবেদন করেছিলেন বড়দিনের রাতে যেন গোলাগুলির অশুভ আওয়াজটা থেমে যায়। সরকারের পক্ষ থেকে সে আবেদন গ্রাহ্য করা হয়নি। কিন্তু অঘোষিতভাবে সে ঘটনাই ঘটে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রথম বড়দিনে। তবে জেনারেল এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের অনেকে এই উৎসবে সরাসরি যুক্ত ছিলেন না। বেশিরভাগ এলাকায় যুদ্ধবিরতি থাকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। বেশ কিছু এলাকায় শান্তির সাদা পতাকা ওড়ে ১৯১৫ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহেও। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে একটি গুলিও চলেনি মিত্রপক্ষ ও অক্ষশক্তির ব্যারাক থেকে। তবে অনেক জায়গায় সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ব্রিটিশ সেনা। এত কাছে জার্মানিদের নিরস্ত্র পেয়ে ব্রাশফায়ার করে তাদের ঝাঁঝরা করে ব্রিটিশরা।
যুদ্ধচলাকালীন শত্রুপক্ষকে এমন উৎসব পালনের আহ্বান জানানো, আগে কখনো ইতিহাস দেখেনি। এই যুদ্ধবিরতি বহু সৈন্যের মুখে হাসি ফোটায়। তারা কদিনের জন্য পরিবারের মানুষের কাছেও ফিরে আসে। এই উৎসবে যারা অংশ নেয়, তাদের ‘সময়ের সেরা ভদ্রলোক’ বলা হয়। যীশু যে শুধুই শান্তির প্রতীক, তার নজির একমাত্র এই ঘটনাটি বলা যায়।
Discussion about this post