রক্তের সম্পর্ক থাকলেই আপনজন হয় বুঝি? ‘চকোলেট দাদু’র সাথে বটো পাহান, ফুলো পাহান, রঞ্জনা ওরাঁও এদের কারোর রক্তের সম্পর্ক নেই। কিন্তু ‘চকোলেট দাদু’ নিঃস্বার্থভাবে এদের প্রয়োজনে যেভাবে পাশে দাঁড়িয়েছেন, সেরকম হয়তো আজকাল আর আত্মীয়-পরিজনেরাও দাঁড়ায় না। ৬৮ বছরের প্রবীণ তাপস কুমার চক্রবর্তী যাকে, তাঁর প্রিয় কচিকাঁচারা ‘চকোলেট দাদু’ নামেই চেনে। বর্তমানে বালুরঘাটের রথতলা এলাকার বাসিন্দা তিনি। যেখানেই আর্তের ডাক শুনেছেন, সেখানেই সশরীরে হাজির হয়েছেন তিনি। পরবর্তীকালে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতকোত্তর হন। চাকরি জীবন শুরু সানাপারা এসসি হাই স্কুলে শিক্ষকতা মাধ্যমে। আজ তিনি অবসর গ্রহণ করেছেন, প্রায় ১১ বছর হতে চলল। অবসর পরবর্তী জীবনে পেনশনের সুবিধা নেই জেনেও তরুণ বয়সে গ্রহণ করা মানব ধর্মকে তিনি কখনোই ছেড়ে যাননি।
আজকের এই দেখনদারির জমানায় তিনি কোন ফ্লেক্স, ব্যানার, রাজনৈতিক দল বা সংগঠন ছাড়াই তিনি শুধুমাত্র তার সহযোগীদের সাহায্যে পৌঁছে গিয়েছেন অনেক প্রত্যন্ত গ্রামে, মানুষের প্রয়োজনে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সাইকেলই ছিল তাঁর বিশ্বস্ত বাহন। মহামারী আবহেও তিনি মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন খাদ্য সামগ্রী থেকে ওষুধ। সঙ্গে পকেটে নিয়ে যেতে ভোলেননি চকোলেটের প্যাকেট, সেই সব কচি কাঁচাদের জন্য। সামর্থ্যে যতোটুকু হয়, তাতেই তিনি ও তাঁর স্ত্রী মিলে বাড়ির পুজোয় তাঁর আপনজনদের জন্য আয়োজন করেছেন ‘মহাভোজ’।
গ্রামের মেয়ের রঞ্জনা ওঁরাও। মা মারা গিয়েছে সেই কবে। বাবা ভিন রাজ্যের শ্রমিক। লকডাউনে মেয়ের বিয়েতে ঘরে ফিরতে পারেননি। কিন্তু তাতে কি রঞ্জনার বিয়ে আটকেছে? তাপস বাবু এবং আরো কয়েকজনের সাহায্যে সেই বিয়ে সুন্দরভাবেই হয়েছে। মাথার উপর যখন চকোলেট দাদুর হাত, তাতে মুশকিল আসান হবেই। তিনি সম্পূর্ণ নিজের খরচে প্রতি বছর মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের গরিব শিক্ষার্থীদের জন্য বই-খাতা-পেনের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতায় শিক্ষা যেন কোনভাবে থেমে না থাকে, এই উদ্দেশ্যেই অনেক ছাত্র-ছাত্রীর প্রাথমিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন তিনি। শুধু পড়াশোনা করলেই চলবে? শরীর ও সুস্বাস্থ্যও বজায় রাখা দরকার। এই বিষয়টিও নজর এড়ায়নি তাপস বাবুর। যাদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়, সেই কৃষক পরিবারের মেয়েদের জন্য তিনি কিনে দিয়েছেন ফুটবল। মেয়েরা যাতে খেলাধুলোয় আরো বেশি এগিয়ে আসে, তিনি উৎসাহ দিয়ে এসেছেন বরাবর।
দাদু শিক্ষা,খাদ্য, দৈনন্দিন জিনিসপত্রের ব্যবস্থা করেই থেমে থাকেননি। পুঁথিগত বিদ্যাকে তিনি বাস্তব রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছেন বারবার। রাস্তার ধারে কতশত পার্থেনিয়াম গাছ আমরা দেখতে পাই। কিন্তু সেসব নির্মূলের ব্যবস্থা নেয় ক’জন? তিনি নিয়েছেন। তিনি ও তাঁর অনুরাগীদের উদ্যোগে সাফ হয়েছে জলঘর থেকে গঙ্গাসাগর পর্যন্ত এলাকার রাস্তার ধারে পার্থেনিয়ামের সমস্ত গাছ। পার্থেনিয়ামের বংশ একেবারে মূল সহ উপড়ে আগুনে পুড়িয়ে তবেই তাঁরা ক্ষান্ত হয়েছেন। দাদুর কাজকে পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও স্বীকৃতি দিয়েছে ‘বঙ্গরত্ন’ উপাধির মাধ্যমে। তাপস বাবুকে দেখে অনুপ্রাণিত হোক আগামী প্রজন্ম। হয়তো তাতে সমাজটা আরেকটু সুন্দর হয়ে উঠবে । ভালো থাকবেন তাপস বাবু, আপনার এই উপকার সমাজ কোনদিনও ভুলবে না।
Discussion about this post