১৯৫৯ সালে মৃণাল সেন পরিচালিত ‘নীল আকাশের নিচে’ সিনেমায় দেখানো হয়েছিল কালী বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত এক চিনাকে। কলকাতায় চিনাদের বসবাস তারও বহু আগে থেকে। সেই কবে থেকে যে চিনারা কলকাতায় নিজেদের আস্তানা গেড়েছিল সে এক আশ্চর্যের বিষয়। কালক্রমে পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ কলকাতায় চিনারা বিস্তার লাভ করে। কিন্তু কলকাতায় চিনা বলতেই টেরিটি বাজার, ট্যাংরা কিংবা চায়না টাউনের কথা মনে আসে কলকাতার বাঙালির।চিনেরা বিভিন্ন রকম পেশায় নিযুক্ত থাকলেও, প্রত্যেকেই কোনো না কোনো একটা চিনা ক্লাবের সাথে যুক্ত। সেই ক্লাব আবার গড়ে উঠেছে একটা মন্দিরকে ঘিরে। এই গঠনটা মোটামুটি হল একটা চিনে মন্দির (যে কোনো এক বা একাধিক দেব-দেবীর), তার একটা নিজস্ব ক্লাব, একটা চিনে রেস্তোরাঁ আর একটা কবরখানা যেটা ওই মন্দিরের নামেই। সেই মন্দির লাগোয়া ক্লাবের সদস্যদের মৃত্যুর পরে কবর দেওয়া হবে সেখানে।
এরকম ছয়টি মন্দির আছে টেরিটিবাজারে, আর সেই মন্দিরের কবরখানাগুলো রয়েছে ট্যাংরা এলাকায়। মজার কথা হলো, যে রাস্তার আশে-পাশের অলি-গলির মধ্যেই ওই কবরখানাগুলো আছে, সেখানেই লোকজন রেস্তোরাঁয় খেতে যায়! এমনি সময়ে কবরখানাগুলো পুরো ফাঁকা আর তালাবন্ধ থাকে। শুধু কিছু বিশেষ চাইনিজ অনুষ্ঠানে খোলা হয়। চিনেদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কাজকর্মে কিছু বিশেষ নিয়ম রয়েছে। এই নিয়মগুলো পালন করা চিনাদের কাছে খুবই জরুরী। কারণ তাদের বিশ্বাস যে এর অন্যথা করলে, মৃতের পরিবারের ওপর দুর্ভাগ্য ঘনিয়ে আসবে।
চিনে পরিবারে বয়স ও পারিবারিক ভূমিকা অনুসারে মৃতের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার নিয়মাবলী নির্ধারিত হয়। বাড়িতে বড় কেউ মারা গেলে, পুরো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দায়িত্ব পরিবারের বড়-ছেলে ও তার সন্তানদের উপরে এসে পড়ে। আবার কোনো দম্পতির যদি শিশুসন্তানের মৃত্যু ঘটে, তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দায়িত্ব মা বাবা নিতে পারেন না। বরং পরিবারের একজন অবিবাহিত ব্যক্তিকে নিতে হয়। আবার কোনো কমবয়স্ক ব্যক্তির মৃত্যু হলে, পরিবারে তার চাইতে বেশি বয়সের লোকজন কোনো শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে পারবে না, এরকম নিয়মও আছে। সেই কারণে পরিবারে কোনো শিশুর মৃত্যু হলে, চুপচাপ তাকে কবর দেওয়া হয় এবং কোনো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার উদযাপন হয় না।
সবথেকে বিচিত্র নিয়ম হলো, কবর দু’বার দেওয়া হয়। প্রথমে কবরখানাতে আলাদা জায়গাতে সাধারণভাবে কবর দেওয়া হয়। এবার দু-তিন বছর পরে, কবর খুঁড়ে মৃতের দেহের অবশেষ (হাড়-গোড় ইত্যাদি) তুলে নিয়ে, তাকে মর্যাদার সাথে পরিবারের অন্য সদস্যের কবরের পাশে পুনরায় দাফন করা হয়। প্রতিটা পরিবারের কবরগুলো, একসাথে একটা ঘোড়ায় ক্ষুরাকৃতির বড়ো কবরের ঘেরাটোপের মধ্যে থাকে। এবার আসি টং অন সিমেট্রির কথাতে। একশো বছরেরও আগে স্থাপিত এই কবরখানা, এখন মোটামুটি দেখাশোনা করা হয়। ভিতরে রয়েছে একটা জলের ছোট ডোবা, যা চাইনিজ অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার নিয়মপালনে ব্যাবহার হয়। খুব একটা বড়ো নয় এই কবরখানাটি। তবে অনেক গাছ রয়েছে। অযত্নে প্রচুর বড়ো বড়ো ঘাস গজিয়েছে। গোটা এলাকাটাই জন-মানবহীন।
মার্চ-এপ্রিল মাসের নাগাদ ‘চিং মিং’ নামের এক উৎসবের সময় এখানকার কবরখানাগুলোতে চিনারা, পরিবারের মৃতের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করতে আসেন। এই সময় কবরগুলো ধুয়ে, পরিষ্কার করে, ফুল দিয়ে সাজানো হয়। সেখান মোম, ধুপকাঠি, বিভিন্ন চিহ্নিত কাগজ জ্বালানো হয়। এর সাথে সাথে, কবরের পাশে কোনো জায়গাতে বসে, পরিবারের সবাই খাবার ভাগ করে খান, অনেকটা যেন চড়ুইভাতি করার মতো। এছাড়া আগস্ট-সেপ্টেম্বর নাগাদ ‘চুং ইউং’ নামের একটা উৎসবের সময়েও, এই কবরখানাগুলোতে চিনারা শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করে থাকে। এভাবেই জনসমক্ষের আড়ালে চিনাদের জীবনের একটা পারলৌকিক অধ্যায় কলকাতার নিউ চায়নাটাউন এলাকায় ফল্গুনদীর মতো বয়ে চলেছে।
চিত্র ঋণ – প্রচ্ছদ চিত্র রঙ্গন দত্ত, অন্যান্য ছবি – ইন্দ্রজিৎ দাস
Discussion about this post