“শুনহ মানুষ ভাই, সবার উপরে মানুষ, সত্য তাহার উপরে নাই।” বড়ু চন্ডীদাস সেই কবে উক্তিটি বলে গিয়েছেন। আর এখন ২০২১। মাঝে কেটে গিয়েছে কয়েকশো বছর, কিন্তু কোনোভাবেই উক্তিটি তথাকথিত ব্যাকডেটেড নয়। আজও মানব ধর্মের জ্বলজ্বল প্রতিমূর্তি চন্ডীদাসের এই উক্তি।
তবে তাঁর জন্মপরিচয় নিয়ে নানা মুনির নানা মত। ১৪১৭ খ্রিস্টাব্দে বীরভূমের নানুর এলাকায় জন্ম বড়ু চন্ডীদাসের। আবার অনেক পন্ডিতের মতে, তাঁর জন্ম বাঁকুড়া জেলার ছাতনা গ্রামে। তাঁর আসল নাম অনন্ত এবং কৌলিক উপাধি বড়ু। ‘চন্ডীদাস’ তাঁর গুরু প্রদত্ত নাম। পরবর্তীকালে সামন্তভূমের রাজা উত্তর হামিরা ,বাসুলি দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে চন্ডীদাসকে মায়ের সেবক হিসেবে নিযুক্ত করেন। তবে চন্ডীদাস শাক্ত দেবী বাসুলির সেবক হলেও বৈষ্ণব সহজিয়া মতের উপাসক ছিলেন। বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়েই তিনি রচনা করেছিলেন ১২৫০ এরও বেশি পদাবলী। চৈতন্যদেবের পূর্ববর্তী সময়ে লিখিত এই পদাবলী একসময় মানুষের মুখে মুখে ফিরত। তাঁর পদাবলীতে মজে ছিলেন স্বয়ং শ্রী চৈতন্যদেব। তবে তাঁর লেখা এইসব পদাবলীর হদিশ ছিল না প্রায় অষ্টাদশ শতাব্দী পর্যন্ত। ১৯০৯ সালে বসন্ত রঞ্জন রায় বিদ্বদ্বল্লভ বাঁকুড়া জেলার কাঁকিল্যা গ্রামের দেবেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় নামক ব্যক্তির বাড়ির গোয়াল ঘর থেকে আবিষ্কার করেন রাধাকৃষ্ণের লীলা বিষয়ক একটি আখ্যান। যে আখ্যানের একাধিক জায়গায় বড়ু চন্ডীদাসের নামের উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৩”×১৩” আকারের এই পুঁথিতে কবি ব্যবহার করেছেন ত্রিপদী ছন্দের। তবে পুঁথি প্রথম এবং শেষ অংশের একাধিক জায়গা নষ্ট হওয়ায়, উদ্ধার করা যায়নি পুঁথিটির আসল নাম। ১৯১৬ সালে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পুঁথিটি প্রকাশ করে ‘শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন’ নামে, যেখানে রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলা কে ১৩ টি খন্ডে তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিটি খন্ডে কবি খুব সুন্দরভাবে উপমা, অলংকারের ব্যবহার করেছেন। বোঝাই যায় মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যকে তরতাজা করেছিলেন চন্ডীদাস।
তবে কবির লেখা শব্দগুচ্ছের পাশাপাশি তাঁর প্রেম জীবনও বহুচর্চিত। রামী এবং চন্ডীদাসের প্রেম কাহিনীকে নিয়ে নানুরে প্রচলিত রয়েছে অনেক কিংবদন্তি। রজকিনী রামীকে তাঁর সাধন সঙ্গিনী হিসেবে গ্রহণ করলে তা মেনে নেয়নি তৎকালীন সমাজ। রামী জাতে শূদ্র হওয়ায়, চন্ডীদাসকে গৃহহীনও হতে হয়েছিল। তবে বর্তমান সমাজ রামী বিহীন চন্ডীদাসকে ভাবতেই যেন অক্ষম। নানুর বাসস্ট্যান্ডের তেরাস্তা মোড়ে জ্বলজ্বল করছে এই যুগলের মূর্তি। চন্ডীদাসের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এলাকার নানা স্কুল-কলেজ ,গ্রন্থাগার।
বাঁকুড়া ছাতনার কামারকুলি মোড়েও রয়েছে বড়ু চন্ডীদাসের একটি মূর্তি। তবে মূর্তির নিচের লিপি ক্ষয়ে গিয়েছে অনেক জায়গায়।একটি গ্রন্থাগার ও কলেজ রয়েছে চন্ডীদাসের নামে। এখানে রয়েছে বাসুলি দেবীর মন্দির। মন্দির সংলগ্ন এলাকায় রয়েছে একটি সংরক্ষণাগারও। মনে করা হয় সেই স্থানেই চন্ডীদাসের জন্ম। এতকিছু থাকলেও এলাকায় পর্যটকের যা কিছু আগমন ঘটে ,সবই ছাতনা থেকে প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত শুশুনিয়া পাহাড়ের দৌলতে। বীরভূমের নানুর লাইমলাইটে এলেও, পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে সেভাবে স্থান করে নিতে পারেনি এই ছাতনা গ্রাম। বড়ু চন্ডীদাসের গুরুত্ব ঠিক কতটা, সেটি ঠিকভাবে তুলে ধরা হয়নি এলাকাবাসীর কাছেও। ফলত বড়ু চন্ডীদাসের মূর্তি ব্যতীত আর কোন নিদর্শনই সেভাবে সহজে চোখে পড়বে না এলাকায়। ঠিক ভাবে সংরক্ষন করা হয়নি এলাকার সংগ্রহশালাও। বড়ু চন্ডীদাসের জন্মভূমির সঙ্গে জড়িত যে গ্রাম তার এ হেন পরিস্থিতি কিছুটা হলেও অবিশ্বাস্য। নানুরের মতো ছাতনাকেও তুলে ধরা হোক পশ্চিমবঙ্গের বাকি মানুষের কাছে। তবেই না চন্ডীদাসকে দেওয়া হবে তাঁর ন্যায্য সম্মান!
কভার চিত্র ঋণ – Chhatna , Bankura ফেসবুক পেজ
Discussion about this post