কানের দুল, মাথার মুকুট কিংবা সীতাহারের মতো রকমারি নকশার গয়না যদি আপনার খাবারের থালায় সাজিয়ে দেওয়া হয়! খুব অবাক হবেন কি? তাহলে আর দেরি না করে চটজলদি পা রাখুন পূর্ব মেদিনীপুরের মাটিতে। দেখবেন আপনার মধ্যাহ্নভোজের থালাটিকে এমনই সাবেকি গয়নার সাজে সাজিয়েই পরিবেশিত করা হবে। যার রূপে মজতে আপনি একরকম বাধ্য। না, এটা কোনো সোনা হীরে খচিত গয়না নয় এ হল গয়নাবড়ি, মেদিনীপুর জেলার সুপ্রাচীন এক শিল্প অলঙ্কার। শীতের কনকনে উত্তুরে হাওয়ায় আদুরে রোদ তখন সবে গায়ে লাগতে শুরু করেছে। ঠিক তখনই পূর্ব মেদিনীপুরের ঘরে ঘরে রব ওঠে গয়না বড়ির। মা ঠাকুমাদের হাত ধরেই এক এক করে বহু শতাব্দীও পার করে ফেলেছে এই গয়নাবড়ি ওরফে নকশাবড়ি।
খাদ্যটি দেখতে যতটাই মনোহরী প্রস্তুত প্রণালীতে রয়েছে ঠিক ততটাই হাড় ভাঙা খাটুনির ছাপ। বিরি কলাইকে ভাঙ্গিয়ে তাকে সারারাত জলে ভিজিয়ে ধৈর্য্য নিয়ে চলে খোসা ছাড়াই পর্ব। সেই ডালকে মিহি করে বেটে ধবধবে সাদা ব্যাটারটিকে ভালো করে ফেটিয়ে নিতে হয়। এরপর মোটা কাপড় বা প্লাস্টিকের মাঝ বরাবর সরু-মোটা ধাতব চোঙ লাগিয়ে ওর মধ্যেই ব্যাটার রাখা হয়। পোস্ত ভরা থালায় এবার জিলাপির মতো হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চলে শৈল্পিক কৌশল। হালকা রোদে বড়িগুলোকে শুকিয়ে ভরে রাখা হয় বৈয়ামে। আর খাবারের থালায় যখন তেলেভাজা খাস্তা ওই বড়ি এসে বসে তার রূপই হয় দেখার মতো। তবে ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় ব্রিটিশ সরকার আসার আগে পোস্ত স্থান পায়নি এই বড়ির প্রস্তুত প্রণালীতে। যবে থেকে বাংলার মাটিতে বেআইনিভাবে আফিমের চাষ শুরু করে ব্রিটিশরা তখন থেকেই এখানে পোস্ত দানার বাড়বাড়ন্ত। ধীরে ধীরে এদেশী বাঙালিদের রান্নাঘরেও তাই ঢুকে পড়ে পোস্তর রকমারি পদ। আর পোস্তমাখা গয়নাবড়ি হয়ে ওঠে রূপে ও স্বাদে অনন্য। শীতের শুরুতেই বাড়ির ছাদে কিংবা ফাঁকা উঠোন জুড়ে দেখা যায় মেয়ে বৌদের গয়নাবড়ি পর্বের জমাটি আসর। পূর্ব মেদিনীপুরের মহিষাদল, নন্দীগ্রাম, সুতাহাটা, তমলুক, পাঁশকুড়া, ময়না, কাঁথি পশ্চিম মেদিনীপুরের ঘাটাল গয়নাবড়ির জন্য বেশ প্রসিদ্ধ এলাকা।
বংশ পরম্পরায় চলে আসা কিছু কৌশল আর দক্ষ হাতের কারিকুরিতে অনন্য সে শিল্পকলার শুভারম্ভ হয় কার্তিক মাসের পোড়া অষ্টমীর দিন। মেদিনীপুর নিবাসী শান্তিনিকেতনের এক ছাত্রীর বাড়ির বানানো গয়না বড়ি দেখে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও তাজ্জব বনেছিলেন। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে গয়না বড়ি গিলে ফেলা মানে সুনিপুণ এক শিল্পকর্মকে নিমেষে ধ্বংস করার সমান। এই গয়না বড়ি যেন গ্রামবাংলার মায়ের এক গয়না ভরা বাক্স। সত্যজিৎ রায়ের ‘আগন্তুক’ সিনেমার পর্দাতেও উঠে আসে ময়নার রাজবাড়ি থেকে পাঠানো নকশাদার এই খাদ্যদ্রব্যটি। সময় আধুনিক থেকে অতি আধুনিক হলেও মেদিনীপুরের এ গলি থেকে ও গলিত; আজও গয়নাবড়ি তার অস্তিত্ব হারায়নি। বরং পূর্ব মেদিনীপুরের এক বনেদি ঐতিহ্য হয়ে সে আজও গর্বের সাথে পাল্লা দিচ্ছে জেলাভিত্তিক জনপ্রিয় খাবারগুলির সাথে। আর হয়তো বেশি দেরী নেই যেদিন পূর্ব মেদিনীপুরের এই অভিনব খাদ্যটি জিআইয়ের মোড়কে বিশ্বদরবারে পরিচিতি পাবে।
প্রচ্ছদ চিত্র ঋণ – ক্যামেজিন
Discussion about this post