কালে কালে শক্তির আরাধনায় মজেছেন বাংলার বহু সাধক। রামপ্রসাদ থেকে রামকৃষ্ণদেব , সকল সাধকের কাছেই ,”কালীই ব্রহ্ম, ব্রহ্মই কালী।”ভক্তি ভরে মাকে ডাকলে, মা সাড়া দেবেন না তা কি হয়! তাইতো, দেশ-বিদেশের নানা প্রান্ত থেকে ভক্তগণ হাজির হয় বোল্লা মায়ের দরবারে। দক্ষিণ দিনাজপুরের বালুরঘাট থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বোল্লা গ্রাম। সেখানে প্রায় ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে পূজিত হয়ে আসছেন মা রক্ষাকালী,যাকে আমরা বোল্লা কালী বলে চিনি। খানিক পেছনে তাকালে বোঝা যাবে ,এই পুজোর ইতিহাস ভারতের ইতিহাসের সাথেও জড়িত।
পাল যুগের শেষ দিক থেকেই বাংলায় শক্তি আরাধনা বাড়তে থাকে।তেমনই, বরেন্দ্রভূমিতে জঙ্গলে ঘেরা এক গ্রামে এক জনৈক সাধক পঞ্চমুন্ডির আসন স্থাপন করে মগ্ন হন কালী সাধনায়।মনে করা হয়, সেখান থেকেই বোল্লা কালী পুজোর সূচনা। পরবর্তীকালে জমিদার বল্লভ চৌধুরী নাম অনুসারে সেই গ্রামের নাম হয় ‘বোল্লা’। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে, গ্রামের জমিদার মুরারী মোহন চৌধুরীই নিয়মিত মায়ের সেবায় নিমগ্ন হন। এবং সেই থেকে প্রতি রাস পূর্ণিমার পরের শুক্রবারে মহা আড়ম্বরে এখানে পূজিতা হয়ে আসছেন রক্ষাকালী মা ।বর্তমানে ‘বোল্লা রক্ষাকালী পুজো কমিটি’ই সব দায়িত্ব সামলায়।
পুজোর দিন দূর-দূরান্ত থেকে আসতে থাকে ভক্তের দল। এই ভিড় সামলাতে মোতায়েন করা হয় এক বিশাল পুলিশবাহিনী। ভক্তদের বিশ্বাস, মা তাদের সকল মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেছেন।তাই তারাও নিজেদের সামর্থ্য মত মাকে শাড়ি ,গয়না ,অলংকার গড়িয়ে দেয়। পুজোর দিন মাকে প্রায় ২০ কেজি ওজনের সোনা ও রুপোর গয়না দিয়ে সাজানো হয়। তাতে যেন মায়ের মূর্তি হয়ে ওঠে আরও মায়াময়ী।দেবীর বাম হস্তের খড়গটিও সম্পূর্ণরূপে সোনার। যা দেখতে পুজোর দিন মন্দিরের সামনে বহু দর্শনার্থী ভিড় জমায়। তবে দূর থেকে আসা ভক্তদের রাত্রিযাপনের চিন্তার কোন কারণ নেই। মূল মন্দিরের সামনের নাট্য মন্দিরে করা হয় থাকার ব্যবস্থা । এর সাথে সারারাত রাস্তায় পাওয়া যায় বিশেষ সরকারি-বেসরকারি, বাস থেকে অটো।
মূল মূর্তির সাথে, মন্দির লাগোয়া আটচালায় পুজো করা হয় ভক্তদের মানত করা শতাধিক কালী মূর্তির ও।সারারাত ধরে চলতে থাকে পাঁচ হাজারেরও বেশি পাঁঠাবলি। পুজোতে গ্রামের মুসলিম পল্লীও যেন সেজে ওঠে নিজেদের মতো করে। বাড়ির দেওয়ালে আঁকানো হয় নতুন নকশা। একসময়ে রক্ষা কালীর সঙ্গে পূজিতা ‘মাদার কালি’কে তারা ও সিন্নি নিবেদন করতেন। ভারতবর্ষের রাজনীতি যখন আজ ধর্মকে কেন্দ্র করে কাদা ছোড়াছুড়িতে ব্যস্ত, তখন দূরে কোথাও অজপাড়াগাঁয়ে এই দৃশ্য অবাক করে দেয়, তাই না?
তবে ইতিহাস-রাজনীতি যাই বলুক,বোল্লা কালী মেলা উত্তরবঙ্গের দ্বিতীয় বৃহত্তম মেলাই বটে! পুজোর দিন মন্দিরের লাগোয়া এলাকায় তৈরি হয় বিপুল জনসমাগম।ভিড়ের ঠেলায় , বাবা যেন হারিয়ে না যায়, তাই শক্ত করে বাবার হাত ধরে থাকে কোন এক শিশু।তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল শহুরে ধাঁচের আদলে এখানে এখনও হারিয়ে যায়নি গ্রাম্য মেলার নিজস্বরূপ। যদি কোথাও পাঁপড়ভাজার দোকান বসে,তো অন্য জায়গায় রাস্তায় গড়াগড়ি খাবে শীতের কয়েতবেল। কোথাও “হরেক মাল দশ টাকায়”,তো কোথাও জমে ওঠে শীত পোশাকের আসর। তিনদিন ব্যাপী এই মেলায় বহু মানুষই, লক্ষ্মী লাভের আশায় দোকান দিয়ে থাকে। কিন্তু করোনার জন্য গত দু’বছর ধরে মেলায় জনসমাগম বন্ধ। তবে মহামারীর দাপটে বন্ধ হয়নি পুজো। হয়তো কোভিড মানুষকে গৃহবন্দি করেছে, কিন্তু মাকে তার সন্তানদের কাছ থেকে আটকে রাখতে পারেনি। ভক্তমনে মায়ের জন্য তাদের ভক্তি ও ভালোবাসা এখনো সমান। তাইতো গ্রামের মানুষ,এখনো অপেক্ষা করছে কবে তাদের গ্রাম আবার ও ‘বোল্লা বোল্লা’ রবে মেতে উঠবে।
Discussion about this post