বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুর শহরটি মল্ল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় একসময় পরিচিত হতো বাংলার ‘শিল্প ভান্ডার’ নামে। এই ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্পগুলির মধ্যে বিষ্ণুপুরী লণ্ঠন একসময় উৎকর্ষের শিখরে পৌঁছেছিল। একটা সময় ছিল যখন সন্ধ্যা নামলে এই লণ্ঠনের স্নিগ্ধ আলোয় ঝলমল করত গোটা বাংলার গৃহস্থালী। আভিজাত্য এবং রুচির প্রতীক এই লণ্ঠন শোভা পেত উৎসবের শোভাযাত্রা ও গৃহসজ্জায়। কিন্তু কালের নিয়মে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টিকে থাকা এই শিল্প আজ বিলুপ্তির প্রায় শেষপ্রান্তে। বৈদ্যুতিক আলো এবং বর্তমানের বাহারি LED আলোর দাপটে লণ্ঠনের শান্ত, স্থির দ্যুতি জীবন থেকে প্রায় মুছে গিয়েছে। একসময় যেখানে ৭০ থেকে ৮০টি পরিবার এই শিল্পের ওপর নির্ভর করত, আজ সেই সংখ্যাটা মাত্র আটে এসে ঠেকেছে। এটি এখন শুধু একটি কুটির শিল্প নয়, এটি বাংলার এক ম্লান হতে চলা ঐতিহ্য।

এই ঐতিহ্যকে আজও সযত্নে ধরে রেখেছেন হাতে গোনা কয়েকজন শিল্পী, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন দিলীপ গড়াই। তাঁর পরিবার শতবর্ষেরও বেশি সময় ধরে এই কারুশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। দিলীপবাবু জানান, এই শিল্প সম্পূর্ণভাবে হাতে তৈরি—কোনো যন্ত্রপাতির ব্যবহার নেই। নির্দিষ্ট ছাঁচ অনুযায়ী টিনের পাত কেটে, কাঁচের টুকরোগুলো ফ্রেমে বসিয়ে ঝালাই করে একটি লণ্ঠন তৈরি করা হয়। কেরোসিনের ব্যবহার কমে যাওয়ায় শিল্পীরা এখন লণ্ঠনে বৈদ্যুতিক বাল্বের হোল্ডার যুক্ত করেন, যাতে ক্রেতারা এটিকে সজ্জার উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন। এছাড়া, বড় আকারের লণ্ঠনগুলিতে মাটির প্রদীপ ব্যবহার করে তা কালীপূজা বা দুর্গাপূজার প্যান্ডেলে বিক্রি হয়। লণ্ঠনের ওপরের অংশে বিষ্ণুপুর মন্দির বা দশাবতারের মতো আলঙ্কারিক নকশা যুক্ত করে এটিকে আরও আকর্ষণীয় করার চেষ্টা করেন শিল্পীরা।
দিলীপবাবুর কথায়, লণ্ঠনের চাহিদা কমে যাওয়ার চিত্রটি অত্যন্ত মর্মান্তিক। তিনি জানান, একসময় দিনে যেখানে ১২৬টি লণ্ঠন তৈরি হতো, এখন মাত্র ১২টি তৈরি হয়—তাও বিক্রি করা কঠিন। গ্রাহকদের ভিড় সামলানো যেখানে কঠিন ছিল, এখন সেখানে সকাল ৭টা থেকে রাত ১টা পর্যন্ত কাজ করেও ক্রেতা পাওয়া যায় না। তিনি আক্ষেপের সুরে বলেন, এই শিল্পে প্রচুর ধৈর্যের প্রয়োজন, যা এখনকার নতুন প্রজন্মের নেই। বর্তমানে যাঁরা এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, তাঁরা সবাই ষাটোর্ধ্ব। দিলীপবাবুর দৃঢ় বিশ্বাস, “আমরা চলে গেলে এই শিল্পও হয়তো আমাদের সঙ্গেই বিলুপ্ত হয়ে যাবে।”
বিষ্ণুপুরী লণ্ঠন আজ কেবলই একটি সজ্জার উপকরণ। প্রবীণ শিল্পীরা যতদিন আছেন, ততদিনই এই ম্লান শিখাটি টিকে থাকবে। এই পরিস্থিতিতে আশার আলো দেখাচ্ছে কলকাতার কিছু উদ্যোগ। দক্ষিণ কলকাতার ‘দ্য বেঙ্গল স্টোর’-এর মতো প্রতিষ্ঠান এই লণ্ঠনগুলিকে সযত্নে প্রদর্শন ও বিক্রির মাধ্যমে বাংলার উজ্জ্বল ঐতিহ্য রক্ষার চেষ্টা করছে। এই ধরনের উদ্যোগই পারে এই প্রাচীন শিল্পটির শিখাটিকে পুনরায় প্রজ্বলিত করতে। বিষ্ণুপুরী লণ্ঠনের পুনরুজ্জীবন ঘটাতে হলে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের প্রশিক্ষণ এবং ক্রেতাদের মধ্যে ঐতিহ্যের প্রতি অনুরাগ বাড়ানো অপরিহার্য।






































Discussion about this post