“সার সন্ঠে রুখ জায়ে, তো ভি সাস্তো জান।” যার মানে একটি মাথার বিনিময়ে হলেও যদি একটি গাছ বাঁচানো যায়, তবে তাই সই। গাছ রক্ষার ইতিহাসে এমন ধরনের কথার সঙ্গে আমরা অনেকেই পরিচিত। মনে পড়ে চিপকো আন্দোলনের কথা? গাছ বাঁচাতে মহিলাদের লড়াইয়ের কথা? সেদিন গাছকে কেটে ফেলার হাত থেকে রক্ষা করতে গাছকে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিলেন মহিলারা। পরিস্থিতির চাপের মুখে পড়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল প্রশাসনও। আবার ভারতের ইতিহাসকে যদি আজ থেকে আরও প্রায় ৩০০ বছর পিছিয়ে দেওয়া যায়, সেখানেও ইতিহাসের গর্ভে লুকিয়ে আরও অনেক অজানা তথ্য।
গাছ রক্ষার্থে ভারতবাসীদের লড়াইটা সম্ভবত প্রথম শুরু হয়েছিল ১৭৩০ সালের সেপ্টেম্বরে বিশনয়ী সম্প্রদায়ের হাত ধরে। মারওয়াড় রাজ্যের মন্ত্রী গিরিধারী ভান্ডারী খেজরলি ঘোষণা করেন রাজপ্রাসাদ নির্মাণের জন্য কাটা হবে গ্রামের বেশ কিছু গাছ। কিন্তু এমন নির্দেশ কিছুতেই মানতে পারেননি সেই গ্রামেরই বিশনয়ী সম্প্রদায়ের মাতা অমৃতা। বিরোধিতা করেন তিনি। মন্ত্রী অনেক চেষ্টা করলেও তাকে টলাতে পারেনি সেদিন। অবশেষে মন্ত্রীর সৈন্যদের হাত থেকে গাছকে বাঁচাতে গাছকে জড়িয়ে ধরে রাখা অবস্থাতেই একে একে গর্দান যায় মাতা অমৃতা ও তার তিন কন্যার। তবে শুধু তারা নয় সেদিন গাছকে বাঁচাতে গিয়ে আত্ম-বলিদান দেন ৩৬৩ জন বিশনয়ী। এমন ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে শেষ পর্যন্ত মারওয়াড় রাজ অভয় সিং-এর নির্দেশে পিছু হটতে বাধ্য হয় সৈন্যরা। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় প্রকৃতিপ্রেমী বিশনয়ীদের গ্রামের কোনও গাছ কোনদিনও কাটা হবে না।
এতো ছিল আজ থেকে প্রায় দু’শো বছর আগেকার কথা। বর্তমান যুগেও বিশনয়ীদের গাছ ও জীবের প্রতি ভালোবাসায় এতটুকুও রদবদল হয়নি। পশ্চিম রাজস্থানের থর মরুভূমির বুকে বংশ পরম্পরায় বসবাস বিশনয়ীদের। ধর্মীয় দিক থেকে বিশনয়ীরা সনাতন ধর্মের বৈষ্ণব ধারাভূক্ত হলেও এদের রয়েছে আলাদা দর্শন। প্রকৃতি পালনই এদের কাছে পরম ধর্ম। মাতৃহারা হরিণ শাবককে মাতৃস্নেহে স্তন্যপান করান বিশনয়ী মা। বিপদে পশু পাখিদের তারা আশ্রয় দেন নিজ গৃহে। পরিবেশ রক্ষার্থে গাছের একটি পাতা পর্যন্ত ছেঁড়েন না তারা। বরং গৃহস্থালির কাজে ব্যবহার করেন কুড়িয়ে পাওয়া শুকনো পাতা, মরা ডাল, গাছের কান্ড কিংবা নারকেলের ছোবড়া ও গোবর। বর্তমান যুগেও বিশনয়ীদের গ্রামে ঢুকে কেউ গাছ বা কোন প্রাণীর ক্ষতি করলে একইভাবে বারংবার গর্জে উঠেছেন তারা।
এই সম্প্রদায়ের মরু এলাকায় বসবাস হওয়ায় এখানকার মাটি অনেকটাই আলাদা। ফলতঃ একপ্রকার জীবন রক্ষার্থেই বিশনয়ীরা যেখানে সেখানে তৈরি করে গুল্মের ঝাড়। এতে একদিকে যেমন মাটি সুরক্ষা পায় আবার অন্যদিকে দুর্ভিক্ষের সময় গবাদি পশুরা তা খেয়ে বেঁচে থাকে। কৃষ্ণসার ও চিঙ্কারা হরিণদের তেষ্টা মেটাতে ক্ষেতের মাঝে তৈরি করা হয় কুয়ো। পাখিদের বাসস্থান তৈরিতে ক্ষেতের মাঝে নির্দিষ্ট দূরত্বে লাগানো হয় উঁচু গাছ। বেগুনি-নীল বর্ণের পোশাক পরেন না তাঁরা। যার বিশেষ কারণ, এই রঙের পোশাক বানানোর জন্য রঞ্জক তৈরিতে কাটতে হয় নীলগাছের সতেজ ঝাঁড়। শুনলে অবাক হবেন, জাতিতে হিন্দু হওয়া সত্ত্বেও গাছ কাটা ও জ্বালানির অপচয় রুখতে মৃতদেহ সৎকারের বদলে কবর দেন এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা। পরিবেশ প্রেমে বিশনয়ীদের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতা সত্যিই হয়তো বিশ্বের হাতে গোনা জাতিরই রয়েছে। বলতে পারবেন পরিবেশকে এমন করে ভালবাসতে আদৌ কি পেরেছে বিশ্বের আর কোনও জাতি?
Discussion about this post