ধরুন , একটি মেয়ে, বিকেলে বন্ধুদের সাথে হৈহৈ করে ঘুরতে গেল অথচ বাড়ি ফিরেই অকারণ দুঃখ তাকে ঘিরে ধরল এবং সে নিজেকে প্রায় চার-পাঁচ দিন ঘরবন্দী করে রাখল। কথা বলা দূরে থাক, খাওয়া দাওয়া পর্যন্ত প্রায় ছেড়ে দিল। এই ধরনের মানসিক অস্থিরতার ঘটনা আমাদের মধ্যে অনেকেই দেখেছি বা শুনেছি, কখনও বা নিজেও এরকম ঘটনার মধ্যে দিয়ে গিয়েছি বা চলেছি। এটি একধরনের মানসিক রোগ, যার নাম ‘বাইপোলার ডিসঅর্ডার’। এই রোগের নামের সাথে এখন আমরা প্রায় সকলেই অল্প-বিস্তর পরিচিত। ‘মানসিক রোগ’ শুনে নাক না সিঁটকিয়ে মানসিক সমস্যাগুলোকে প্রথম থেকেই গুরুত্ব দিলে রোগীর মনের কষ্ট এবং রোগের ভয়াবহ পরিণামকে অনেকাংশে কমানো সম্ভব।
এই বাইপোলার ডিসঅর্ডারের সঠিক কারণ এখনও অজানা। তবে কিছুক্ষেত্রে বংশগতিকে এর অন্যতম একটি কারণ বলে চিহ্নিত করা গিয়েছে। এছাড়া এমন কোন ঘটনা যা মারাত্মক মানসিক চাপ তৈরি করে, তাকেও এই রোগের কারণ বলে ধরা হয়। এই ধরণের মানসিক রোগীদের মধ্যে দু’ধরনের ব্যক্তিত্বের পর্বের পর্যায়ক্রম দেখা যায়। প্রথম: ম্যানিয়া পর্ব- এই সময় অত্যন্ত বেশিরকম উচ্ছ্বাস দেখা যায়। আত্মবিশ্বাসও মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায় যা মাঝে মাঝে বিপজ্জনক হয়। অত্যন্ত বেশি যৌনস্পৃ্হাও দেখা যায়। রোগী অকারণে অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে শুরু করেন। কখনো কখনো হ্যালুসিনেশনও করে থাকেন রোগী। দ্বিতীয়: ডিপ্রেশন বা বিষণ্ণতা পর্ব – ভীষণভাবে একাকীত্বে ভুগতে শুরু করেন রোগী। খাবার ইচ্ছে, যৌন ইচ্ছে, মনোসংযোগ করার ক্ষমতা চলে যায় এবং আত্মহত্যা করার প্রবণতা বেড়ে যায় এই পর্বে।
লক্ষ্য করার বিষয় হল, ম্যানিয়া পর্বটির স্থায়িত্ব অনেক কম হয় ডিপ্রেশন পর্বের নিরিখে। এছাড়াও আছে ‘মিশ্র পর্ব’ যেখানে আনন্দ অনুভব করার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই অস্বাভাবিক বিষাদ ঘিরে ধরে এবং রোগী যখন তখন যেখানে সেখানে কেঁদে ফেলেন। এইসব মানসিক সমস্যার সুত্রপাত শৈশবে হলেও কৈশোরে পৌঁছে লক্ষ্যণগুলো প্রকট হতে শুরু করে। সেই সময় পরিবারের সদস্যদের রোগীর প্রতি সহানুভূতিশীল এবং সহনশীল থাকা ভীষণভাবে দরকার। এসবক্ষেত্রে বন্ধু-বান্ধব থেকে শুরু করে পাড়া-প্রতিবেশীদেরও মানবিক হাত বাড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
বলাই বাহুল্য, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে থেকে শুরু করে উইনস্টন চার্চিল, সেলিনা গোমেজ এবং আরও বহু বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্ব এই মানসিক রোগের শিকার ছিলেন। মনে রাখতে হবে, এই রোগের সম্পূর্ণ নিরাময় এখনও সম্ভব হয়নি। ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী নিয়মিত ওষুধের ব্যবহারে অনেকটা সুস্থ থাকা সম্ভব হয় এবং দৈনন্দিন জীবনের রুটিনে একটু স্বাস্থ্যকর পরিবর্তন, ব্যায়াম, মেডিটেশন- এসবই শরীরের সাথে সাথে মনকেও সুস্থ রাখতে অনেকটা সাহায্য করে। শরীরে রোগ বাসা বাঁধলে যেমন ডাক্তারের কাছে যেতে হয়, ঠিক সেরকমই মনের মধ্যে কোন সমস্যা দেখা দিলে দেরি না করে অবশ্যই মনোরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা আমাদের সকলকেই মানবিকতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। মানসিক রোগীরা যে সমাজে ব্রাত্য নন, সেটা বুঝতে হবে এবং তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে ওঠার জন্য সমাজের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকতে হবে।
Discussion about this post