কলমে ইফতেখার উদ্দিন বাংলাদেশি গণমাধ্যমকর্মী
জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা সস্ত্রীক ঢাকায় চলে আসলেন। রেস কোর্স ময়দানের মঞ্চ প্রস্তুত। আছেন মিত্র বাহিনীর উপ সেনাপতি উইং কমান্ডার একে খন্দকার। ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের দুই নং সেক্টরের স্থলাভিষিক্ত অধিনায়ক মেজর এটিএম হায়দার বীর উত্তম। তিনি নিয়াজীকে অস্ত্র তাক করে নিয়ে আসেন রেসকোর্সের মঞ্চে। ১৯৭১ সাল, বিকেল চারটা ৩১ মিনিট। নিয়াজী আত্মসমর্পণ পত্রে সই করার সাথে সাথেই ঢাকার আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে স্লোগান উঠলো “জয় বাংলা-জয় হিন্দ, মিত্রবাহিনী- মুক্তিবাহিনী জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ। ইন্দিরা- মুজিব জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ। সহযোদ্ধাকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন কেউ কেউ। প্রমাণিত হলো বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সে উক্তি, “কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবা না।” কেউ দাবিয়ে রাখতে পারেনি, বাঙালী জাতি জয় ছিনিয়ে এনেছেই। আর সেই বিজয়ের সারথী ভারতীয় সেনাসহ মিত্রবাহিনী।
এই বিজয়ের আগে রয়েছে অনেক ঘটনা, অনেক স্নায়ুযুদ্ধ। বাংলাদেশের মুক্তি যোদ্ধারা দীর্ঘ নয় মাস লড়াই করেছেন মাঠে, জলে- জঙ্গলে। শেখ মুজিব বন্দী, তাঁর ফাঁসি কার্যকর করতে চায় পাক সরকার। ভারতীয় সেনারা ভারতে বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধাদের দিয়েছেন যুদ্ধের রসদ ও প্রশিক্ষণ। দেড় কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়া পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। তবে সবচেয়ে কঠিন ও দুঃসাহসিক লড়াইটি লড়েছেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাথে ভারতের তৎকালীণ প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বাকযুদ্ধ যেন তার প্রমাণ।
নিচের অংশটুকু পড়া যাক: “ভারত যদি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানো বন্ধ না করে, তাহলে আমেরিকা চুপ করে বসে থাকতে পারে না। ভারতকে শিক্ষা দিতে বাধ্য হবে।” – মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন। “আমেরিকাকে ভারত বন্ধু মনে করে, বস্ নয় ! ভারত তার ভাগ্য নিজেই লিখতে জানে! আমরা জানি কাকে কিভাবে জবাব দিতে হয় !” -উত্তরটা ছিলো ইন্দিরা প্রিয়দর্শিনী গান্ধীর। ১৯৭১ এর নভেম্বরে ভারত মার্কিন যৌথ সাংবাদিক সম্মেলন বাতিল করে, হোয়াইট হাউসে বসে মার্কিন রাষ্ট্রপতি রিচার্ড নিক্সনের চোখে চোখ রেখে ঠিক এই কথাগুলিই বলে গটগট করে উঠে চলে এসেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। ইউএসের তৎকালীন মার্কিন এশিয়া বিষয়ক সচিব হেনরী কিসিঞ্জার তাঁকে গাড়িতে ওঠার সময়ে বলেছিলেন, “ম্যাডাম প্রাইম মিনিস্টার, প্রেসিডেন্ট স্যারের প্রতি আরেকটু ধৈর্য্য দেখালে বোধ হয় ভালো করতেন!” উত্তরে ইন্দিরা গান্ধী তাঁকে বলেছিলেন – “থ্যাঙ্ক ইউ মিস্টার সেক্রেটারি ফর ইওর ভ্যালুয়েবল সাজেশন! বিইং এ ডেভলপিং কান্ট্রি উই হ্যাভ ব্যাকবোন এনাফ টু ফাইট দ্য এ্যাট্রসিটিস! উই শ্যাল প্রুভ দ্যাট ডেজ আর গন টু রুল এনি নেশন ফার ফ্রম থাউজেন্ডস অফ মাইলস!!”
একজন মানুষ কতটা দৃঢ়চেতা হতে পারেন আবার তার প্রকাশ কতটা বিনয়ী! পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে জরুরী অবস্থার মধ্যে প্রায় দেড় কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে, তিনি মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাঙালীর পাশে দাঁড়িয়েছেন। তার মেরুদণ্ড এতোটাই শক্ত ছিলো। বাংলাদেশ ও বাঙালীর অবিসংবাদিত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর কোথায় যেন মিল আছে। শিঁরদাড়া উঁচু, চির উন্নত মম শির। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভুটান পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মঞ্চ এবং ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির জটিল সমীকরণকে বাংলাদেশের অনুকূলে নিয়ে আসার কৃতিত্ব এককভাবে ব্যক্তি ইন্দিরা গান্ধীরই।
বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের গভীরতা ও ব্যাপ্তি সম্পর্কে শ্রীমতি ইন্দিরার ধারণা ছিলো বিস্তৃত, সম্যক। ভারতের ইতিহাসে এখনও পর্যন্ত কোনো বিদেশি রাষ্ট্র নায়ককে সম্মাননা দেবার সর্বোচ্চ রেকর্ড শেখ মুজিবের। ১৯৭২ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি কলকাতার ব্রিগেড মাঠে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সংবর্ধনা দেন ইন্দিরা গান্ধী। এতে অংশ নেন ১০ লাখের বেশি জনতা। সবার মুখে এক বুলি, “কেউ দাবায়া রাখতে পারবা না।” ত্রিশ বছর আগে এই কলকাতা থেকে মুজিবের ছাত্র রাজনীতি শুরু, ত্রিশ বছর পর সেই মুজিব এই কলকাতায় পেলেন বিরল সম্মাননা। ইন্দিরা গান্ধী যেন মুজিবকে দেখিয়ে দিলেন, ছাত্র মুজিব কলকাতার একটি কলেজ ইউনিয়নের সম্পাদক ছিলো। আজ সে মুজিব এক রাষ্ট্র নায়ক হিসেবে কলকাতায় এসেছে।
১৯৭২ এর ১৭ মার্চ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শ্রীমতি প্রিয়দর্শিনীর সংবর্ধনায় তিনি বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সেনা তুলে নেন। যেটা ছিলো বন্ধু শেখ মুজিবের জন্মদিন ১৭ মার্চের উপহার। বিশ্বের ইতিহাসে এত দ্রুত মিত্র পক্ষের সেনা তুলে নেবার ইতিহাস বিরল। বাংলাদেশকে তুলে দিলেন নির্বাচিত সরকারের হাতে। তখন নৌকার আদলে একটি মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছিল। পরবর্তী সামরিক শাসক জেনারেল জিয়ার শাসনে সেটি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। ইতিহাসের ভুল সংশোধনের জন্য মঞ্চটি পুনর্নিমাণ হওয়া খুব উচিত। মৃত্যুর এত বছর পরেও শ্রীমতি গান্ধী ও শেখ মুজিব আমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনসাধারণের কাছে ইন্দিরা গান্ধী চিরদিন অম্লান হয়ে থাকবেন এক অনন্য উচ্চতায়। জয় বাংলা- জয় হিন্দ, ইন্দিরা-মুজিব জিন্দাবাদ।
Discussion about this post