প্রতি বছর ফাগুন মাসের শেষ তিন দিন বিভিন্ন আচারের মাধ্যমে বাংলাদেশের ভাটি অঞ্চল করে এক বিশেষ আয়োজন। এটি আসলে একটি লৌকিক পুজো। বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল এলাকায় কৃষিজীবী সনাতন ধর্মাবলম্বীরা এ পুজোর আয়োজন করে থাকেন। বাংলাদেশের বৃহত্তর যশোর-খুলনা, বরিশাল-ফরিদপুর অঞ্চলের মানুষ ভাটি পুজো করে। মূলতঃ ভাটি অঞ্চলের পূজা বলেই একে ভাটি পুজো বলা হয়। ভাটি অঞ্চলের কৃষিজীবী নমঃশূদ্র, কাপালি, পুণ্ড্র ক্ষত্রিয়, মুণ্ডা, ঋষি, বাগদীর মতো কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই পুজোর প্রচলন রয়েছে। এছাড়া বাইতি, বাওয়ালি, মাওয়াল, মাঝি, ঘোষ, কর্মকার, কুমার, ছুতার, নরসুন্দর প্রভৃতি পেশাজীবী মানুষের মধ্যেও দেখা যায় এই প্রথা।
এটি একটি মাতৃতান্ত্রিক সমাজের পুজো। এর উপাস্য একজন দেবী, যিনি গৃহপালিত জন্তু এবং মানুষকে ঘা-পাঁচড়ার রোগ থেকে রক্ষা করে। এই দেবীর কোনো বিগ্রহ নেই। কোনো প্রকার মূর্তিও তার কল্পনা করা হয় না। গ্রামের থান বা গ্রামের বাইরে কোনো গাছতলায় এই পুজোর স্থান নির্ধারিত থাকে। বট, পাকুড়, জিয়ল, নীম, কেওড়া প্রভৃতি গাছের নিচে পুজো অনুষ্ঠিত হয়। এসব গাছই ভাটি দেবীর আশ্রয় বলে স্বীকার করা হয়। পুজোর সময়ে পূজারীরা তাঁকে নানা প্রকার গালাগাল দেয়। তাদের ধারণা দেবীকে তুষ্ট করতে না পারলে তাকে ভর্ৎসনার মাধ্যমে তার রোষ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। এর পূজারী সাধারণত নারী এবং শিশু। পূজায় তথাকথিত কোনও পুরোহিত লাগে না। কোথাও কোথাও এটি হ্যাঁচড়া পুজো নামেরও প্রচলিত।
ভোরবেলা গ্রামের শিশুরা কুলোয় পুজোর বিভিন্ন উপাচার সাজিয়ে নিয়ে যায়। প্রথম দু’দিন উপাচারের মধ্যে থাকে কেবল নানা প্রকার ফুল। যেমন, ভাঁটফুল, মান্দার ফুল, নীলকণ্ঠ, কল্কে, কাঠ গোলাপ, শিয়াল কাঁটা ইত্যাদি। কুলোর ওপর বুয়ো (পুঁই) গাছের পাতা বিছিয়ে তার উপর ফুল সাজিয়ে নেওয়া হয়। এর পর থানের গাছকে ঘিরে সকলে তাদের কুলো বৃত্তাকারে সাজিয়ে রাখে। মহিলারা একে একে শুরু করেন গান…
সমবেতভাবে কয়েকটি গান পরিবেশিত হয়। এরপর একে একে কুলার ফুল গাছের গোড়ায় ঢেলে দেওয়া হয়। ফুল নিবেদনের পর শিশু-কিশোরেরা তাদের কুলো একটি লাঠি দিয়ে তালে তালে বাজাতে বাজাতে ঘরে ফেরে। ঠিক পরের দিন ভোরে ফুল তোলার নিমন্ত্রণ দিয়ে তারা ঘরে ফেরে। পরের সকালে আবার যথা নিয়মে আবার পুজো শুরু হয়। পুজোর শেষ অনুষ্ঠানিকতা হয় তৃতীয় দিনে। এদিন যে সকল আচার পালন করা হয় তা অভিনব।
কুলোর উল্টা পিঠে সব উপাচার সাজানো হয়। কুলোর মাথার দুই দিকে কিছুটা গোবর দিয়ে তার উপর দুটো মরা শামুক বসানো হয়। শামুকের মধ্যে দেওয়া হয় মেয়েদের মাথার কিছু ছেড়া চুল, দুটি ডেলা, ভাঁটফুলের পাতা, তেল, সিঁদুর, জল ইত্যাদি। বাড়ি যে কয়টি গরু থাকে সেই কয়টি ভাঁট পাতা নিয়ে যাওয়া হয়। গাছতলায় গিয়ে গাছের গোড়ায় প্রথমে তেল দেওয়া হয়। এর পর জল, সিঁদুর দেওয়া হয়। প্রসাদ বাড়িয়ে দেওয়া হয়। প্রসাদ হিসেবে খেঁজুর গুড়ের চিনি, বাতাসা, নাড়ু, নারকেল, খই দেওয়া হয়। নৈবেদ্য বাড়ানোর পর ভাট পাতাগুলো নিয়ে আসা হয়। এর পর গরুকে পুকুরে নিয়ে গা ধোওয়ানো হয়। এক একটি ভাঁট পাতা দিয়ে এক একটি গরুর শরীরকে পরিষ্কার করা হয়। বাড়ি ফিরে পরিবারের সবাইকে স্নান করতে হয়। এরপর সন্ধ্যায় পাড়ার সবাই মিলে মাঙন করা চাল-ডাল-সবজি দিয়ে খিচুড়ি রেঁধে খাওয়া হয়।
Discussion about this post