বাংলা নতুন বছরের ক্যালেন্ডার মুঘল আমলে খাজনা শোধ করাকে ঘিরে তৈরি হলেও বাংলার মাটিতে প্রথম ঘটা করে বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনা করেছিলেন কবি ঈশ্বর গুপ্ত। এই উপলক্ষ্যে প্রকাশ করেছিলেন সংবাদ প্রভাকরের একটি বিশেষ সংখ্যাও। সময়টা ১৮৩৫ সাল। কলকাতায় ব্রিটিশদের জাঁকজমকের কাছে বাঙালির সব উৎসবই তখন বড়ো ঘরোয়া আর ক্ষীণ। বাবু-জমিদারদের আড়ম্বরপূর্ণ বার্ষিক দুর্গাপুজোয় সাধারণের হাঁ হয়ে দেখার বেশি আনন্দ করার সামর্থ ছিল না। ততোদিনে ঘাড়ে এসে বসা ব্রিটিশদের দৌলতে ইংরেজি বর্ষবরণের আদবকায়দার সাথে সকলে পরিচিত। বাঙালিরও নিজস্ব একটা গোটা ক্যালেন্ডার ছিল বৈকি। তবে ক্যালেন্ডারে পয়লা বৈশাখ তখনও চাষীদের খাজনা শোধ আর ব্যবসায়ীদের হালখাতার তারিখের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল।
কবি-সাংবাদিক ঈশ্বর গুপ্ত ছিলেন সে যুগের বিখ্যাত সংবাদপত্র সংবাদ প্রভাকরের সম্পাদক। উনিশ শতকে যে সময় তাঁর সংবাদপত্র আত্মপ্রকাশ করে, বাংলায় তখন এক অস্থির টালমাটাল অবস্থা। সংবাদ প্রভাকরের পাতায় প্রতিদিনই উঠে আসছে হিন্দু গোঁড়ামি, মধ্যযুগীয় অন্ধবিশ্বাসকে দু কথা শুনিয়ে এগিয়ে চলার কথা, সাম্যতা আর আধুনিক মানসিকতার কথা। সেই সময় দাঁড়িয়ে এ এক বিশাল কর্মকান্ড, যার কান্ডারি ছিলেন স্বয়ং কবি ঈশ্বর গুপ্ত।
বাংলার এইরূপ দিনযাপনে হঠাৎই কবি ঈশ্বর গুপ্ত এক বছর বাংলা নববর্ষ উদযাপনের তোড়জোড় করলেন। আয়োজন করলেন এক মহা ভোজসভার। শহরের তাবড় ‘বাবু’দের নিমন্ত্রণের পাশাপাশি ব্যবস্থা হল চারপাশের সাধারণ মানুষগুলোর খাওয়া দাওয়ার। পয়লা তারিখে কলকাতার বাসস্থল লোকে লোকারণ্য, গমগম করছে ভিড়। হাটখোলার দত্ত, জানবাজারের মথুর বিশ্বাস, সমাজ সংস্কারক প্রসন্ন ঠাকুর, সমাজসেবী ও শিক্ষাবিদ ব্রজমোহন দত্ত, জোড়াসাঁকোর দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর কবির আন্তরিক নিমন্ত্রণ পেয়ে উপস্থিত সবাই। ইংরেজের উপনিবেশ কলকাতা মহানগরী বাংলা নববর্ষ উপলক্ষ্যে এরকম জনসমাগম আগে কখনও দেখেনি। কথিত আছে, আয়োজন ও লোক সমাগমের বহর অনায়াসে টেক্কা দিতে পারতো সাহেবদের নিউ ইয়ার পার্টিকে।
অনুষ্ঠানের আমেজও ছিল ষোলোয়ানা বাঙালির। কবিতা পাঠ, গানের আসর, কবির লড়াই, শ্লোক চর্চা সব মিলিয়ে গানে, গল্পে, আড্ডা- আলোচনায় প্রকৃত অর্থে বর্ষবরণের রূপ নিয়েছিল সেদিনের পয়লা বৈশাখ। কারও কারও মতে, কবি ঈশ্বর গুপ্তর এই নববর্ষ পালনই বাংলার ইতিহাসে কলকাতার বুকে হওয়া সর্বপ্রথম বর্ষবরণ উৎসব এবং বাংলা নববর্ষ পালনের সূচনাকালও। সেদিনের অনুষ্ঠান শেষে কবিকে সবাই চেপে ধরলো কবিতা পাঠের জন্য। পাঠ করা হল খাঁটি বাংলায় তৎক্ষণাৎ স্বরচিত কবিতা। সে কবিতার সর্বাঙ্গে ছিল ইংরেজদের উদ্দেশ্যে ব্যাঙ্গ। পাঠ শেষে সভা কলরবমূখর হয়ে উঠেছিল কোলাকুলি ও জয়ধ্বনিতে। এইভাবে শেষ হয়েছিল সেবারের নববর্ষ আর শুভারম্ভ হয়েছিল আধুনিক নববর্ষের পথ চলা।
Discussion about this post