দীপাবলির প্রদীপ যখন একে একে নিভে যায়, মনে হয় উৎসবের পালা শেষ। আলোর আড়াল থেকে ভেসে আসে হেমন্তের শিরশিরানি, ভোরের হাওয়ায় টের পাই ঋতু পরিবর্তনের স্পর্শ। আর হেমন্তের আগমনের সাথে সাথেই বাংলায় আগমন ঘটে দেবী হৈমন্তিকার, যিনি সারা বাংলায় দেবী জগদ্ধাত্রী নামেও পরিচিত হন। গোটা জগতকে ধারণ করেন যিনি, তিনিই তো জগদ্ধাত্রী। দেবী দুর্গা ও দেবী কালীর বিদায়ের পর মাতৃশক্তির পুনরাবির্ভাব ঘটে দেবী জগদ্ধাত্রী রূপে, যাঁর উপাসনা না করলে বাঙালির দেবীপূজা কখনোই সম্পূর্ণ হয় না।
কার্তিক মাসের শুক্লা নবমী তিথিতে দেবীর আরাধনা সম্পন্ন হয়। বাংলায় জগদ্ধাত্রী পুজোর ঐতিহ্য নিয়ে কথা বললে অবশ্যই উঠে আসে কৃষ্ণনগর ও চন্দননগরের নাম। কৃষ্ণনগরসহ বাংলার অধিকাংশ স্থানে একদিনের মধ্যেই সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীর পূজা শেষ হয়। তবে চন্দননগরই একমাত্র ব্যতিক্রম—এখানে মহাষষ্ঠী থেকে মহাদশমী পর্যন্ত জগদ্ধাত্রীর আরাধনা চলে দুর্গাপুজোরই মতো জাঁকজমকে। মণ্ডপে মণ্ডপে ডাকের সাজ, শোলার কাজ, আলোর উৎসবে ভরে ওঠে সমগ্র শহর।
কলকাতারও আছে তার নিজস্ব জগদ্ধাত্রী পুজোর ঐতিহ্য। উত্তর কলকাতার শোভাবাজার অঞ্চলে অবস্থিত বটকৃষ্ণ পালবাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজো সেই উত্তরাধিকার বহন করে আসছে প্রায় এক শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে। ১৮৯৩ সাল। দেশীয় ওষুধ ব্যবসায় “বটকৃষ্ণ পাল অ্যান্ড কোং” তখন এক পরিচিত নাম। দারিদ্রের কণ্টকাকীর্ণ জীবন পার করে বটকৃষ্ণ পাল গড়ে তুলেছিলেন ৭৭ নম্বর বেনিয়াটোলা স্ট্রিটের এক বিশাল প্রাসাদাকৃতি বাড়ি। স্বপ্ন ছিল মায়ের আরাধনা করার—নিজস্ব ভক্তি ও বিশ্বাসের জগতে। কিন্তু যেহেতু তাঁর স্ত্রী স্বপ্নাদেশ পান শিবপুরের বাড়িতে মা অভয়ার পুজো করার, তাই বটকৃষ্ণ পাল নিজের বেনিয়াটোলার বাড়িতে শুরু করেন জগদ্ধাত্রী পুজো।
১৯০০ সালে যে ঐতিহ্যের সূচনা, তা আজও অটুট। এ বাড়ির জগদ্ধাত্রী শোভিত হন লাল শাড়িতে, সিংহের পিঠে বাবু হয়ে বসেন তিনি। চারপাশে থাকেন তাঁর চার সখী। ধাতুনির্মিত বাহারি নকশাকাটা চালচিত্র লাল কাপড়ে আবৃত থাকে, সিংহের গায়ে আকুন্দ তুলোর সূক্ষ্ম লোমের আবরণ—এক নিপুণ শিল্পকর্ম যেন। প্রতি বছর দেবীর জন্য তৈরি হয় নতুন শাড়ি, গহনা। নতুন আভরণে সেজে উঠে দেবী অধিষ্ঠান করেন সিংহের পিঠের ওপরে। পুরো ঠাকুরদালান সেজে ওঠে ফুলের সাজে। সঙ্গেই দেবীর চার সখীও সেজে ওঠেন ফুল হাতে নতুন ঘাঘরা চোলিতে।
এই বটকৃষ্ণ পালের বাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজোও সম্পন্ন হয় নবমীর দিন। এদিন সকাল থেকে তিন পর্যায়ে সম্পন্ন হয় পুজো। অষ্টমীর সন্ধিপুজোয় দেবীকে নিবেদন করা হয় চালের নৈবেদ্য, গোটা ফল, আর সাজানো হয় ১০৮টি পদ্মফুল ও পিতলের প্রদীপ। এই পুজোর অন্যতম আকর্ষণ কুমারী পূজা এবং সন্ধ্যার ধুনো পোড়ানো, যেখানে বাড়ির সব মহিলাই একত্রে মাতেন ভক্তি ও আনন্দে।
তবে শুধু পুজো নয়, প্রতিমা নিরঞ্জনের সময় যে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রার আয়োজন করা হয়, তা দেখে আজও বাড়ির প্রবীণ সদস্যদের আগেকার দিনের উৎসবের ছবি মনে পড়ে যায়। আলোকসজ্জিত লরিতে বসে মা, সঙ্গে চার সখী। ঢাক, ঢোল, কাঁসর বাজিয়ে এগিয়ে চলে শোভাযাত্রা কলকাতার রাজপথ ধরে গঙ্গার দিকে। পথের দু’ধারে মানুষের উল্লাস, আলো আর ধোঁয়ার মিশ্রণে তখন শহর যেন ফিরে যায় উনিশ শতকের কলকাতায়। বটকৃষ্ণ পালবাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজো কেবল এক পারিবারিক ঐতিহ্য নয়—এ যেন এক সেতুবন্ধন, যেখানে ইতিহাস, ভক্তি, ঐশ্বর্য আর আলোর প্রতীক একত্রিত হয়ে জেগে ওঠে।






































Discussion about this post