সেই দিনটার কথা মনে পড়ে? প্রথম যেদিন আধো আধো গলায় বুলি আওড়েছিলেন অ, আ, ই, ঈ। সত্যি বলতে ছোট্টবেলার কিছু কিছু স্মৃতি বড় হয়ে একদমেই অস্পষ্ট হয়ে পড়ে। কিন্তু চকখড়ি বা স্লেট পেনসিলের মতো হঠাৎ যেদিন খুঁজে পাওয়া যায় সেটিকে অবচেতনে সযত্নে রাখা স্মৃতিটা হুট করেই জেগে ওঠে। তেমনই একটি মিষ্টি স্মৃতির টুকরো হল গোলাপি মলাটে ঢাকা অতিপরিচিত বর্ণপরিচয় বইটি। বাংলা বর্ণের সাথে বাঙালির পরিচয় পর্বের প্রধান উপকরণ। আমাদের ছেলেবেলা থেকে পরের প্রজন্ম, শিশুকে কোলে বসিয়ে এই অক্ষর পরিচয়ের ধারা বাংলার ঘরে ঘরে আজও দেখতে পাবেন। আর এই অমূল্য সম্পদটির রচয়িতা কে তা তো নতুন করে বলার কিছু নেই। সেই বেঁটে খাটো সাদা ধুতি আর গায়ে চাদর জড়ানো লোকটা, চিরকালীন চিরস্মরণীয় পন্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর।
বর্ণপরিচয় আসার আগে পর্যন্ত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যম বলতে ছিল শুধুই সংস্কৃতের গুরুগম্ভীর শব্দগুলো। সেসব একরকম দুর্বোধ্য এবং জটিল। তাই বিদ্যাসাগরমশাই স্থির করলেন এই জটিল সংস্কৃতকে সরিয়ে বাংলা ভাষা ও ইংরেজী ভাষা শিক্ষার প্রসার ঘটাবেন বাংলায়। আর সে বিষয়ে বিস্তর জল্পনার পর প্যারীচরণ সরকারের সঙ্গে এক সিদ্ধান্তেও এলেন। ইংরেজী ভাষার দায়ভার প্যারীচরণবাবুর কাঁধে তুলে নিজে বাংলা ভাষার দায়িত্ব নিয়ে বসলেন। আর নিমেষেই রচনা করে ফেললেন প্রথম শিশুশিক্ষা বিষয়ের দ্বিখন্ডিত গ্রন্থ বর্ণপরিচয়। প্রথমটিতে স্বর ও ব্যঞ্জনবর্ণ সম্বন্ধে যাবতীয় পাঠ। আর দ্বিতীয়টিতে সংযুক্ত বর্ণের বিস্তৃতি। আর ওদিকে প্যারীচরণ সৃষ্টি করলেন ‘ফার্স্ট বুক অফ রিডিং’। শোনা যায় মফঃস্বলের বিদ্যালয় পরিদর্শনে যাওয়ার পথে পালকির মধ্যে দুলকি চালেই বিদ্যাসাগরমশাই লিখে ফেলেছিলেন বর্ণপরিচয়ের পান্ডুলিপি। ১৮৫৫ সালে আজকের দিনেই (মতান্তরে ১ এপ্রিল) প্রকাশিত হয় বর্ণপরিচয়ের প্রথম ভাগটি। বিহারীলালবাবুর মতে প্রথমের দিকে এই বইয়ের প্রতি তেমন আগ্রহ না থাকলেও পরে হু হু করে আকর্ষণ বেড়ে চলল খুদের অভিভাবকদের। পঠন পাঠন হল অপেক্ষাকৃত অনেক সহজ। সে সময় মাত্র দু’পয়সায় হাটে পাওয়া যেত বইটি।
আজ ১৩ এপ্রিল বর্ণপরিচয় পা রাখল ১৬৫ বছরে। কিন্তু আজও এর পুরনো বইটির গৌরব মলিন হয়নি। তবে আজকের যন্ত্রসভ্যতার যুগে শিশুদের অডিও ভিজুয়্যালের মাধ্যমে পঠনের রীতি চালু হয়েছে। অক্ষর পরিচয়ের আগেই তাদের পরিচয় ঘটে যায় মোবাইলের সঙ্গে। তবুও সরকারের সহায়তায় বর্ণপরিচয় আজও শিশুপাঠের প্রধান গ্রন্থ হিসেবে অনুমোদন রয়েছে। এরপরেও হারায়নি বর্ণপরিচয়ের সেই আবেগী অস্তিত্বটা। শিশু বিকাশে বহু বই এলেও বর্ণপরিচয় তার স্থানে এখনও অটুট ও সচল।
Discussion about this post