‘তন্ত্রচূড়ামণি’ অনুসারে দেবী কপালিনী, শিবচরিতে তিনি ভীমরূপা, আর ‘পীঠমালাতন্ত্র’ তাঁকে বলে কপালিনী ভীমরূপা। এই রহস্যময়তার মধ্যেই জড়িয়ে রয়েছেন পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুকের অধিষ্ঠাত্রী দেবী বর্গভীমা। একান্ন সতীপীঠের অন্যতম এই শক্তিপীঠে আজও তন্ত্রসাধনার ধারায় চলে পুজো, বিশেষ করে কালীপুজোর দিনে মাকে রাজবেশে সাজিয়ে মহা ধুমধামে পুজো করা হয়। পুরাণ মতে, সতীর বাম পায়ের গোড়ালি এই স্থানে পড়েছিল, সেই থেকেই এই স্থানে দেবীর আরাধনা চলছে সহস্রাব্দ ধরে। দেবী এখানে বিরাজমান উগ্রতারা রূপে কালো পাথরের মূর্তিতে, যার নিচে রয়েছে শায়িত শিবের প্রতিমা। চতুর্ভুজা দেবীর ডানহাতে খড়্গ ও ত্রিশূল, বাম হাতে খর্পর ও মুণ্ড। শাস্ত্রীয় ও লোককথার মিশেলে এক অপার মায়া ও শক্তির কেন্দ্র হয়ে উঠেছে এই বর্গভীমা মন্দির।
তমলুকের রাজা তাম্রধ্বজ বা গরূড়ধ্বজকে ঘিরে রয়েছে নানা জনশ্রুতি। এক কাহিনিতে বলা হয়, রাজপরিবারে এক ধীবরপত্নী প্রতিদিন জ্যান্ত শোল মাছ দিতেন। সারা বছর কীভাবে জ্যান্ত মাছের জোগান দেন ওই ধীবরপত্নী? এই প্রশ্ন জাগে রাজার মনে। পরে জানা যায়, এক রহস্যময় কূপের জল ছিটিয়ে রোজ মরা শোল মাছকে জীবন্ত করতেন ওই ধীবরপত্নী। এই ঘটনাক্রমেই দেবীর মূর্তি আবিষ্কৃত হয় জঙ্গলের কুয়োর ধারে। আবার মঙ্গলকাব্যে আছে, সিংহলগামী এক সওদাগর তমলুকে নোঙর করে এক কূপের জলে পিতলের কলস সোনায় পরিণত হতে দেখে বিস্মিত হন এবং সেই কূপের পাশে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। বিভিন্ন লোকশ্রুতি এই মন্দিরকে ঘিরে তৈরি করেছে এক অনন্য কিংবদন্তির জাল, যা আজও তমলুকবাসীর ধর্মবিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দু।

দেবী বর্গভীমার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে শোল মাছ। তাই মন্দিরে আজও প্রতিদিন মাকে নিবেদন করা হয় শোল মাছের ঝোল। ভক্তরা মিষ্টি ভোগ ছাড়াও তাল, কচু, ওল এবং শোল মাছ নিয়েই হাজির হন দেবীর কাছে প্রার্থনা করতে। ধীবর সম্প্রদায়ের আরাধ্যা দেবী ‘ভীমা’ নামের সঙ্গেও এর যোগ রয়েছে বলে মনে করা হয়। বছরের নানা সময় ভিন্ন রূপে দেবীর পুজো হয় — কখনও তিনি কালী, কখনও জগদ্ধাত্রী। তবে কালীপুজোর দিন এই মন্দিরে উপচে পড়ে পুণ্যার্থীর ঢল। মায়ের মূর্তি সারাদিন অলংকারে আবৃত থাকলেও রাতের ভোগ প্রদর্শনের সময় সেই সব সরিয়ে রাখা হয় এবং পরদিন পুজোর আগে ফের অলংকৃত করা হয় মাকে।

তমলুক শহরে দুর্গাপুজো হোক বা যেকোনও শুভ কাজ সবই শুরু হয় দেবী বর্গভীমার আরাধনার মধ্য দিয়েই। মন্দিরের ওড়িশি স্থাপত্যশৈলী, প্রায় ৬০ ফুট উঁচু দেউল এবং দেওয়ালের টেরাকোটা কাজ আজও মুগ্ধ করে দর্শনার্থীদের। গর্ভগৃহে মা বিরাজ করছেন মহিমায়। লোকশ্রুতি আছে, দেবীর মন্দিরের পাশে থাকা পুষ্করিণীতে ডুব দিয়ে পাওয়া যে কোনও বস্তু লাল সুতো দিয়ে মন্দিরের পার্শ্ববর্তী গাছে বাঁধলে মনস্কামনা পূর্ণ হয়। হাজার বছরের ইতিহাস, মিথ, তন্ত্রাচার ও লোকবিশ্বাসে গাঁথা মা বর্গভীমার মন্দির তমলুকবাসীর কাছে শুধু ধর্মস্থল নয়, এক জীবন্ত ঐতিহ্য।
চিত্র ঋণ – মলয় মন্ডল, বনি দত্ত, মৌমিতা ঘোষ, গৌতম রায়
Discussion about this post