বর্ষা কাটিয়ে সারা বাংলায় হাজির হয়েছে শরৎ। আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছে সাদা তুলোর মতো মেঘ, মাঠে মাঠে দুলছে কাশফুল। বাংলার শরৎ মানেই দুর্গাপুজোর আগমনী বার্তা। এই সময়েই যেন প্রকৃতির প্রতিটি রঙে মিশে থাকে উৎসবের মায়া। পুজো আসছে, কথা শুনলেই প্রতিটা বাঙালির স্বপ্ন ও কল্পনায় ভেসে ওঠে দুর্গাপুজোর দিনগুলোর ছবি। দুর্গাপুজোর শপিং, ঠাকুর দেখা, খাওয়া দাওয়া সব যেন এক নিমেষে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। কারণ, এই একটি উৎসবের জন্য বাঙালিরা অপেক্ষা করে থাকেন সারা বছর। আর এই উৎসবের প্রাণস্পন্দন যে বাদ্য, তা নিঃসন্দেহে ঢাক। ঢাকের বাজনা দিয়েই যেন শুরু হয় উৎসবের, ঢাকের আওয়াজই নিয়ে আসে আনন্দের পশরা। তাই এই দুর্গাপুজোর আগেই এখন শুরু হয়ে গেছে ঢাকিদের ঘরে সাজোয়া প্রস্তুতি।
বাঁকুড়া শহরের অদূরেই রয়েছে কেঞ্জাকুড়া গ্রাম। সর্পিল পথ বেয়ে গ্রামে ঢুকতেই দু’পাশে সুদূর প্রান্তর, সাদা কাশফুলের সমুদ্র। আর এই গ্রামের এক কোণে রয়েছে ঢাকিদের একটি পাড়া। এখানে প্রায় দশ-পনেরোটি পরিবার বছরের অন্য সময় নানা কাজ করলেও দুর্গোৎসবের ক’টা দিনের ওপরেই তাঁদের বছরের উপার্জনের সিংহভাগ নির্ভর করে।
এই গ্রামেরই ঢাকিরা বলেন, “দুর্গাপুজোর সময়টা আমাদের জন্য সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ। পুজোর চারটে দিনে অন্তত দশ হাজার টাকা রোজগার করা যায়। তাই ঢাক সারানো, বাঁধন শক্ত করা—সবকিছু নিয়েই এখন আমাদের ব্যস্ততা। অন্যান্য সময় যে কাজই করি না কেনো, এই দুর্গাপুজোর সময়টায় আমরা আমাদের সারা বছরের রোজগার সঞ্চয় করি।”
বাঙালির উৎসবের সঙ্গে ঢাকের সম্পর্ক যেন রোমিও-জুলিয়েটের মতো অবিচ্ছেদ্য। শারদোৎসবের দিনগুলিতে ঢাক ছাড়া কল্পনাই করা যায় না। মহালয়ার ভোরে রেডিও বা টেলিভিশন থেকে ভেসে আসা চণ্ডীপাঠের সঙ্গে ঢাকের ঢমঢম শব্দই যেন এক অন্য আবেশ তৈরি করে। ঢাকিদের এই জীবিকা কেবল অর্থনৈতিক নয়, সাংস্কৃতিকও। তাদের বাদ্যই পুজোর আবহ তৈরি করে। পুজোর আগে বাজারে যেমন সাজ সাজ রব, তেমনি ঢাকিদের গ্রামেও শোনা যায় প্রস্তুতির সুর।
ঢাকিদের জন্য দুর্গাপুজো কেবল আনন্দের উৎসব নয়, জীবিকারও উৎসব। বছরের অন্য সময় হয়তো কেউ কৃষিকাজে হাত লাগান, কেউ ছোটখাটো ব্যবসা করেন। কিন্তু শরৎ এলে, ঢাক হাতে নিলেই তাঁদের চোখে ভেসে ওঠে আনন্দের আলো। তবুও, এই পেশা এখন নানা সংকটে। শহরের অনেক পুজোয় এখন মিউজিক সিস্টেম ঢাকের জায়গা নিচ্ছে। তবুও ঢাকিদের আশা, যতদিন বাঙালি তার ঐতিহ্যের শিকড় ভুলবে না, ততদিন ঢাকের বাদন বাজতেই থাকবে।
কাশফুলের সাদা ঢেউ আর ঢাকের আওয়াজ মিলেমিশে বাংলার শরতের আকাশে ভাসাচ্ছে আগমনী বার্তা। পুজো যেন শুধু উৎসব নয়, এ যেন মানুষের প্রাণের সঙ্গীত। ঢাকিরা তাই বলেন—“ঢাক বাজলেই মনে হয় মা আসছেন। আমাদের পরিশ্রম, আমাদের বাজনা—সব মিলিয়েই তো পুজোর প্রাণ।”
Discussion about this post