তাপস বাপি দাস, সঙ্গীত শিল্পী, ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’র সদস্য – শুভ নববর্ষ স্বাগত। কিন্তু নববর্ষ কতটা শুভ হবে সেটা আমার আপনার মতো শুভ চিন্তকদের ওপর নির্ভর করে না। আমি নিশ্চিত নতুন বছর শুভ হবে না কারণ দেশের চালিকা শক্তিরা কেউ বলছেন ‘রগড়ে দেব’ আবার অন্য কেউ বলছেন ‘আমি জাত গোখরো’। ছোট-মেজ বড় সবমিলিয়ে ৩ লক্ষ কারখানা বন্ধ রয়েছে গত কুড়ি বছরে, তবুও শুভ নববর্ষ। রোজ এই সোনার বাংলায় ধর্ষণ চলছে, খুন খারাপি তবুও শুভ নববর্ষ। তবুও স্বপ্ন দেখি, “নিশিদিন ভরসা রাখিস হবেই হবে ওরে মন হবেই হবে”। আরও একবার শুভ নববর্ষ।
লুবনা লিমি, সঙ্গীত শিল্পী (বাংলাদেশ) – উদযাপন ও আয়োজন যেমনই হোক না কেন, সবারই চাওয়া—নতুন বছর ভালো কাটুক, সম্পর্ক দৃঢ় হোক, পৃথিবীতে শান্তি নেমে আসুক,পৃথিবী করোনা মুক্ত হোক।আমরা নিতান্তই স্বপ্নবাজ স্বপ্ন আমাদের বাঁচিয়ে রাখে,নতুন বছরের কাছেও তাই বিশাল আশা আমাদের।নতুন বছর নতুন নতুন কাজের বিপুল উৎসাহ নিয়ে আসুক। বিগত দিনের ক্ষতি পূরণের সুযোগ তৈরী করুক। অসঙ্গতি অপূর্ণতা কাটিয়ে উঠার সুবর্ণ সুযোগ নিয়ে আসুক প্রতিটি নতুন সকাল। চাই করোনা মুক্ত একটি নতুন ভোর, নতুন সূর্য। বিগত বছরের অপূর্ণতা কমি-খামি কাটিয়ে উঠার এবং পুরো উদ্যোমে কাজ শুরু করার আরেকটি সুযোগ এনে দিক এই নববর্ষ।পরিশেষে রবি ঠাকুরের মতই চাইবো “মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জরা,অগ্নি স্নানে শুচি হোক ধরা।”
সন্দীপন মুখার্জী, পশুপ্রেমী – প্রথমেই সকলকে নববর্ষের আন্তরিক অভিনন্দন এবং শুভকামনা জানাই। বিগত বছর সমগ্র মানবসমাজকে অস্তিত্ব সংকটের মুখোমুখি এনে ফেলেছিল এবং তার রেশ এখনও বর্তমান। এই পরিস্থিতিতে নতুন বছরে আমাদের সবচেয়ে বড় স্বপ্ন মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনা মুক্ত পৃথিবী। ১৪২৭ মানব জাতিকে যে অভিজ্ঞতা, যে প্রাকৃতিক জ্ঞান দিয়েছে তার প্রেক্ষিতে একজন পশুপ্রেমী এবং প্রকৃতিপ্রেমী হিসেবে সভ্য মানুষের প্রতি আমার বার্তা, প্রকৃতি শুধুমাত্র মানবসমাজ নিয়ে নয়। মানুষের সাথে পশু সমাজও প্রকৃতির সন্তান। সমাজের সর্বোত্তম জীব হিসেবে সাধারণ পশুপাখি এবং প্রকৃতির ওপর নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতা বন্ধ করে মানুষের যে দায়বদ্ধতা তা মানুষ যদি যথাযথভাবে পালন করে তাহলে এক সুন্দর সমাজ তৈরি সম্ভব হবে।
উষসী চক্রবর্তী, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশনের যুব কর্মী – নতুন বছরে মহামারী মুক্ত হওয়ার স্বপ্ন আমরা কম বেশি সবাই দেখছি। আমরা সবাই নিশ্চিন্তে আবার স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবনে ফিরে যেতে চাই। আমরা সবাই আমাদের খারাপ অভিজ্ঞতাগুলোকে ভুলে, নতুন করে সবটা শুরু করার কথা ভাবি নতুন বছরে। তবে আমরা কেউ নিজেদের ভুল গুলো কে শুধরে নেওয়ার কথা ভাবি না, যেটা ভাবা আমাদের প্রত্যেকের জন্য খুব জরুরি। আমরা সবাই এতো বেশি ভার্চুয়াল হয়ে গেছি, যার ফলে এক একজন মনুষ্যত্বহীন যন্ত্রে পরিণত হয়ে যাচ্ছি। এই যন্ত্র হওয়া থেকে নিজেরাই নিজেদের বাঁচাতে পারি, নতুন বছর থেকেই না হয় এই চেষ্টা শুরু হোক। ১৪২৮ সালে এসেও আমরা অনেকে কুসংস্কার থেকে বেরনোর কথা ভাবতে পারি না, অথচ ডিগ্রি হিসেবে এক একজন এর শিক্ষাগত যোগ্যতা বিরাট। নতুন বছরে আমরা ডিগ্রির ভিত্তিতে নয়, কুসংস্কার ভেঙে মন থেকে বরং প্রকৃত শিক্ষা লাভের চেষ্টা শুরু করি। ছেলে মেয়ের ভেদাভেদ না করে, উভয়কেই না হয় একই রকম সন্মান ও স্বাধীনতা দেওয়া শুরু হোক এই নতুন বছর থেকেই।
অরুণ কুমার চক্রবর্তী, কবি এবং ‘লাল পাহাড়ির দেশে যা’র স্রষ্টা – আসল কথা হল, সময় অনন্ত। কোথায় শুরু হয়ে কোথায় শেষ হয়েছে আমরা জানি না। সেই বিস্তারিত সময়কে আমরা নিজেদের সুবিধার্থে খন্ড খন্ড ভাবে বিভাজিত করেছি। ২৪ ঘন্টায় দিন, ৭ দিনে সপ্তাহ কিংবা ৩০ দিনে মাস। সেই সূত্রে শকাব্দ, খ্রীস্টাব্দ, বঙ্গাব্দ তৈরি হয়েছে। কাজেই সেখানে একটি নতুন কিছু শুরু হবে এটাই স্বাভাবিক। আমার মনে হয় প্রতি বছরে আমরা কতোটা মানুষ হলাম তার একটা বিচার দরকার। আমার একটাই কথা, প্রত্যেক নতুন বর্ষে আমরা যেন নতুন ভাবে উজ্জীবিত হয়ে ক্রমশঃ মানবতার পথে হাঁটতে পারি। কারণ “মানুষ বড় কম পড়িয়াছে।” আমি মনে করি মানুষ শ্রেষ্ঠ হলেও কিছু প্রশ্ন রয়েছে। যে ষড় রিপু আমাদের চালনা করছে, সেখানে আমাদের চিন্তা করতে হবে এই নেগেটিভ শক্তিগুলিকে কীভাবে পজিটিভ শক্তিতে রূপান্তরিত করা যায়? একটা ভালো গান করার কামনা করতে পারি, একটি কবিতা লিখে ফেলার লোভ হতে পারে, এভাবেই বছরের প্রথম দিনে ভাবতে পারি।
ঋদ্ধি চ্যাটার্জী (কল্লোলিনী), কণ্ঠ শিল্পী – অন্যায়হীন, আপোষহীন সত্যের একটা পৃথিবীর স্বপ্ন তো আমরা সবাই দেখি! এই বাংলা নববর্ষে একটু অন্যভাবে ভাবা যাক – একটু নতুন কিছুর স্বপ্ন দেখা যাক ! আচ্ছা কখনো কী ভেবে দেখেছেন , বঙ্গভঙ্গ হয়ে লর্ড কার্জন এখন ভূতের পুত কিন্তু আজও আসে এই একটা দিন, যেদিন আমরা ডাকি ‘বাংলা নববর্ষ’। আর এ ‘বাংলা’ কিন্তু শুধু ভারতবর্ষের পূর্ব কোলের পশ্চিমবঙ্গ নয়, এই নববর্ষ কাঁটাতার ছিঁড়ে আমাদের বাংলাদেশেরও। কাঁটাতার বিছোনোর এত যুগ পরেও, বাংলা নববর্ষই একমাত্র দিন, যা জুড়ে দেয় দুটো বাংলা কে, উপড়ে যায় মাঝের সামাজিক দূরত্ব যার পোশাকি নাম ‘কাঁটাতার’। তা, বিষের এই বছরে ঠিক কী নতুন ভাবতে পারি আমরা? সবার প্রথমে একটা বাঁচার মত পৃথিবী, যেখানে রোজ সকালে মৃত্যুর হার মাপতে হবে না। করোনা হীন এক ক্যালেন্ডার আমাদের সবার একমাত্র স্বপ্ন। এমন একটা সকাল যেখানে মাস্কের ফাঁকে মর্নিং ওয়াকটা আর সারতে হবেনা। একটা নতুন বছর – সোশ্যাল ডিসটেন্সিং, করোনা, পিপিই কিট, কোভিড, কনটেইনমেন্ট জোন, মাস্ক – এই বিষাক্ত শব্দগুলো যেখানে আর ছড়াবে না।
আচ্ছা এরপর আসা যাক , একটু অন্যদিকে। বাড়িতে দাদু দিদার আচার খাই তো আমরা? অবশই খাই। বেশ, তাহলে দাদু দিদার পুরনো ট্রানজিস্টার রেডিওটা কেন ফেলে দিই? তার বদলে স্মার্ট ফোনের বদহজম করা নেশাটা কাটিয়ে একটা রেডিও সিগনালে ভরা সকাল – যুববাণীর আওয়াজে গমগম করা একটা দুপুর – বিবিধ ভারতীর সেই সাবেকী মেজাজ কিংবা বীরেন্দকৃষ্ণ ভদ্রের সেই ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে’ মুঠোফোনে না আটকে, বরং ট্রানজিস্টারেই মহালয়ার আসর – ঠিক এরকম একটা ‘বেতার মোড়া দিনের স্বপ্ন’ কী আমরা দেখতে পারিনা! এপার বাংলার নতুন লেখকদের সাহিত্য ওপার বাংলায় কতোটা পৌঁছয়? একইভাবে ওপারের সাহিত্য সৃষ্টি কতোটা উঁকি মারে এপারের সাহিত্যপ্রেমীদের বুকলিস্ট জুড়ে? তাই সাহিত্যের প্রেমিকা হয়ে দেখতে চাই এই নতুন বাংলা বছরে দুই বাংলার প্রতি ঘরে ঘরে ‘শ্রীজাত’ র পাশাপাশি ‘শিমুল’ও থাক। সবশেষে , আজ, ১৪২৭ এর চৌকাঠে দাঁড়িয়ে, আমার আপনার তোমার – আমাদের সবার আবদারে, ইচ্ছেয় এবং সচেতনতায় আমরা এই কোভিড বিশ্বযুদ্ধ কাটিয়ে সুস্থ হয়ে উঠি আর সাহিত্যে শিল্পে আমাদের এই চর্চা চলতে থাকুক। নতুন বছর আমাদের শুভ হোক – বিষ কেটে বিজয়া আসুক – নিকোটিন ছাপিয়ে নববর্ষ আসুক, শুভ ১৪২৮।
সৌগত সিংহ, পেশাদার চিত্রগ্রাহক – এক অদ্ভুত এবং ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে আমরা ১৪২৮ কে স্বাগত জানাতে চলেছি। কিছু স্বার্থপর, অশুভ মানুষের নীতি, সমাজে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার নিকষ অন্ধকার ধীরে ধীরে আমাদের গ্ৰাস করছে। এমতাবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই নতুন বছর আমাদের কিঞ্চিৎ আশার আলো নিয়ে আসবে এই স্বপ্ন আমরা দেখছি। রবি ঠাকুরের ভাষায় বলতে গেলে “কুহেলিকা করি উদঘাটন সূর্যের মতন।” নতুন ভোর, নতুন দিন এর মতো স্বাভাবিক ভাবেই নতুন বছরে ও অনেক স্বপ্ন দেখছি। প্রথমেই বাঙালি হিসেবে চাইব বাংলা ভাষার সামগ্ৰিক প্রসার, দ্বিতীয়তঃ মানুষের মধ্যে যে এক বিপজ্জনক অস্থিরতার সৃষ্টি হয়েছে তার অবসান একান্ত কাম্য। পরিশেষে ‘ডেইলি নিউজ রিল’ এর সমগ্র সদস্যকে সাধুবাদ জানাই, যারা এই সময়ে একক প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষাকে অবলম্বন করে এই নিউজ পোর্টালটি এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। সবাই ভাল থাকবেন।
কম্পোজার পার্থ, সঙ্গীত শিল্পী – যখন আমরা কোন নতুন বছরে পা রাখি, আমরা সবসময়ই স্বপ্ন দেখি, এমন কিছু ঘটুক আমাদের জীবনে যা আমাদের প্রতিদিনকার একঘেয়েমিতে একটু ভিন্ন স্বাদ এনে দিক। আমরা সমাজবদ্ধ জীব, তাই একা একা ঘরবন্দী হয়ে, নিজেদের ফিলিংসগুলো একে অপরের সাথে শেয়ার না করলে আমাদের দম বন্ধ হয়ে আসে। বর্তমান আর্থোসামাজিক পরিস্থিতিতে আমরা সকলেই নানান সমস্যায় জর্জরিত এবং ভীষণ একা। এর সাথে গত এক বছরের কোভিড-১৯ মহামারীর কারনে কার্যত আমরা প্রায় নাজেহাল ও গৃহবন্দী। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আমি এই নতুনের স্বপ্ন দেখি যেখানে মানুষ আবার একে অপরের সাথে অবাধ মেলামেশা করতে পারবে, তাদের অনুভূতিগুলো শেয়ার করতে পারবে ভয়ডরহীন ভাবে।
“হেথা হতে যাও পুরাতন,
হেথায় নতুন খেলা আরম্ভ হয়েছে। আবার বাজিছে বাঁশি, আবার উঠিছে হাসি,
বসন্তের বাতাস বয়েছে।”
সৌরভ প্রকৃতিবাদী, পরিবেশ আন্দোলন কর্মী – ঠিক এই সময় নতুন বছরের আগমন উদযাপিত হয় বাংলা, আসাম, কেরল, মায়ানমার সহ দক্ষিণ এশিয়ার বহু দেশেই। উৎসব সংস্কৃতির অংশ, সংস্কৃতি জীবন নির্ভর, জীবন প্রকৃতি নির্ভর। তাই রাষ্ট্রের কাঁটাতার পেরিয়ে নানা ধর্ম বর্ণ ভাষার মানুষ একই সাথে অভ্যর্থনা করতে পারেন একই উৎসবের৷ আমি এমন একটা পৃথিবী চাই, মায়ের আঁচলের মতন। যে আঁচলকে কাঁটাতারের বেড়ায় শত ছিন্ন করা হয়েছে, প্রকৃতির আদর্শ তাকে জুড়ে নেবে আজ না হয় কাল। প্রতিটি বৈশাখ আমায় সে স্বপনে মাতিয়ে রাখে।
অ্যানি আহমেদ, সঙ্গীত শিল্পী, ‘আ ডট ইন দ্য স্কাই’য়ের সদস্য – একজন শিক্ষিকা এবং সঙ্গীতশিল্পী হওয়ার সুবাদে আমার নতুন বছরকে ঘিরে ভাবনা স্বভাবতই সঙ্গীত এবং শিক্ষাকে আলিঙ্গন করে। নতুন বছরে আমি এবং আমার ব্যান্ড যেন শ্রোতাদের নতুন গান উপহার দিতে পারি। চাই আমার ছাত্রছাত্রীরা ভালো ফল করুক। বড্ড অস্থির এই সময়, চাইব মুক্তমনা মানুষের সংখ্যা বাড়ুক। এই নববর্ষে নতুন এবং সৎ চিন্তা-ভাবনার জন্ম হোক। নতুন ভোর হোক নতুন আলো নিয়ে, যে আলোয় থাকবে শান্তি এবং স্বচ্ছতার বার্তা। তবে একটা চলতি কথা রয়েছে, “স্বপ্ন হলেও সত্যি।” এই স্বপ্নগুলো কি আদৌ সত্যি হবে! তা জানা নেই। তবে আমাদের আশাবাদী থাকতে হবে। নতুন বছরে সব্বাই ভালো থাকুক ও সব্বাইকে ভালো রাখুন।
Discussion about this post