“সে রাজ্যে ছিল হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া, রাজকোষে ছিল হিরে মুক্ত পান্না চুনি।” সাথে ছিল আরো একটি জিনিস যা হল ‘ডাইনোসরের ডিম’! প্রাণী জগতের আদিম অধিপত্য ঠিক কতটা প্রকট ছিল তা আমাদের ভাবায় বৈকি! ‘Survial of the Fittest’ বা বাংলায় যাকে বলে যোগ্যতমের উদ্বর্তন, ডারউইনের এই তত্ত্বের উপর দাড়িয়ে গোটা জীবজগৎ। প্রকৃতি যতটা অনুকূল, সময়ে ঠিক ততটাই প্রতিকূল হয়ে পড়ে। আর এই প্রতিকূলতার থেকে বেঁচে ফিরবে তারাই যারা প্রকৃতিতে টিকে থাকার জন্য প্রকৃত উপযুক্ত আর বাকিরা সময়ের কোলে হারিয়ে যাবে। তেমনই এক প্রাণী ডাইনোসর যারা প্রায় ৬৫ মিলিয়ান বছর আগে বিবর্তনের নিয়মে হারিয়ে যায়।
আমেদাবাদ শহর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে বালাসিনোর শহর। অথচ এই ২০ কিলোমিটারের যাত্রায় যেন প্রায় ১০ কোটি বছর পিছিয়ে আসতে হয়। সালটা ছিল ২০০৩। সেই সময় ওই এলাকায় এক গ্রামবাসী মশলা গুঁড়ো করার জন্য একটুকরো পাথর যোগাড় করেছিলেন। পাথরটি অন্যান্য শিলাখন্ড থেকে ছিল একটু আলাদা। রংটাও ছিল খানিক অন্যরকম। আলিয়া সেইটিকে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। এই আলিয়া সুলতানা বাবি হলেন বালানিসোরের প্রাক্তন রাজ পরিবারের কন্যা। পরে তিনি জানতে পারেন সেটি ৯.৯০ কোটি থেকে ৬.৫০ কোটি বছর আগের টিটাননোসারাস ডিমের জীবাশ্মরূপ। ‘রাজকুমারী’ আদর করে ওটিকে বলেন, ‘মশলা ডিম’। ওটি লাল ভেলভেটের গয়নার বাক্সে সাদা সিল্কের কাপড়ে মুড়ে আপাতত রাজকুমারীর হেফাজতে আছে।
যদিও এতে অবাক হননি তিনি। গুজরাটের এই এলাকা আগেই অবাক করেছে বিজ্ঞানীদের। বালসিনোরের প্রাক্তন রাজপরিবারের মালিকানাধীন ৭২ একর জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অসংখ্য জীবাশ্ম। ১৯৮০-র দশকে বিষয়টি প্রথম সকলের সামনে আসে রুটিন ভূতাত্ত্বিক সমীক্ষায়। জানা যায়, এখানে পাওয়া জীবাশ্ম ৬.৭০ কোটি বছরের পুরনো এবং বিজ্ঞানীরা এর নাম দিয়েছেন রাজাসারাস নর্মদেনসিস। উল্লেখ্য, নর্মদা নদীর আশেপাশেই এই এলাকা। ডায়নোসরের ফসিলরূপী প্রায় ১০ হাজার ডিম এখানে পাওয়া যায়। এই শহরের মাঝেই রয়েছে একটি বিরাট এলাকা, যা তাদের ডিম পাড়ার জায়গা ছিল বলেই মনে করা হয়। প্রায় ৪ বছর ধরে পরীক্ষা নীরিক্ষা চলার পর অবশেষে বিজ্ঞানীরা সিদ্ধান্তে এলেন, এই জীবাশ্ম আসলে ডাইনোসরের। এই আবিষ্কার সাড়া ফেলেছিল কারণ ভারতে ডাইনোসরের বসতির এখানে এই প্রথম খোঁজ মেলে।
ডায়নোসরের এই দীর্ঘদেহী প্রজাতির উচ্চতা ছিল প্রায় ৩০ ফুট। এরা ছিল মাংসাশী। এরা প্রধানত পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম ডাইনোসরাস। দীর্ঘ গলার এই ডাইনোসরের মাথায় ছিল ঝুঁটিওয়ালা শিং। এই শিংটিকে মুকুটের সাথে তুলনা করে এদের ‘রাজা’ নামকরণ হয়। শুধু তাই নয় তৃণভোজী ডায়নোসরদেরও বিচরণভূমি ছিল এই এলাকা। বিশেষজ্ঞদের অনুমান, প্রায় সাত রকম প্রজাতির ডায়নোসর এখানে বসবাস করত। বিজ্ঞানীদের মতে প্রায় ১৪৪ মিলিয়ন বছর আগে এই এলাকায় ডাইনোসরের বসতি শুরু হয়। তখন জায়গাটি ছিল আফ্রিকান ভূখণ্ডের মধ্যে। সময়ের সাথে সাথে পৃথিবীর মানচিত্র বদলাতে থাকে। আফ্রিকার ভূখণ্ডের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন হয়।
রাজকুমারীর উদ্যোগে বালাসিনোর শহরে ৭২ হেক্টর জমি নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি ফসিল পার্ক। বালানিসোর ঘুরতে যাঁরা আসেন তাঁদের চোখে পড়ে এই সুবিশাল জন্তুর ফাইবার গ্লাসের মডেল। আজও জিওলজিক্যাল সার্ভের গবেষকরা পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছেন এই এলাকায়। আলিয়া সুলতানা বাবিও কাজ করে যাচ্ছেন নিজের মতো করে। তাঁর উদ্দেশ্য এই প্রত্নক্ষেত্রটির সংরক্ষণের বিষয়ে মানুষকে উৎসাহিত করা। বর্তমানে এটি ভারতের এক বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্রের রূপ নিয়েছে। এখনও পর্যন্ত ১৩ টি ডাইনোসরের প্রজাতি পাওয়া গিয়েছে এই এলাকায়। এর মধ্যে রাজাসোরাস এবং অন্য একটি প্রজাতি সম্পূর্ণ নতুন, পৃথিবীর আর কোথাও তাদের সন্ধান মেলেনি। হয়তো পরবর্তীকালে আরও রহস্যময় কোনো প্রজাতির সন্ধান পাওয়া যাবে ভারতের এই ‘জুরাসিক পার্কে’।
Discussion about this post