হিন্দু শাস্ত্রে উল্লেখ আছে তেত্রিশ কোটি দেবতার কথা। যাঁদের অধিকাংশেরই কথাই আমাদের অজানা। গুজরাতের ইতিহাসে এমনই এক দেবীর গল্প শোনা যায় যিনি একজন সাধারণ নারী হয়েও বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে হয়ে ওঠেন সমাজের এক শ্রেণীর মানুষের কাছে আরাধ্যা দেবী। গুজরাতের মেহসানা জেলায় বাপাল ও ডেথার কন্যা ছিলেন বহুচরা। তবে নানান ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গুজরাতের বেচার্জিতে ১৭৮৩ সালে তৈরি হয় বহুচরা মাতার মন্দির। এই বহুচরা আসলে রূপান্তরকামীদের দেবী বলেই পরিচিত। কথিত রয়েছে তার কৃপায় নিঃসন্তানও সন্তান সুখ লাভ করে।
যদিও নিতান্তই সাধারণ নারী হয়েও কিভাবে রাজকন্যা থেকে বহুচরা হয়ে উঠলেন আরাধ্যা পূজনীয় সে গল্প সত্যিই রোমহর্ষক। কথিত আছে রাজকন্যা বহুচরার বিবাহ হয় গুজরাতের এক রাজপুত্রের সঙ্গে। যদিও এই বিবাহতে সেই রাজপুত্রের কোন ইচ্ছা ছিল না। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও বিয়ে করায় রাজপুত্র তার স্ত্রী বহুচরার প্রতি তার কোন দায়িত্ব কর্তব্য পালন করতেন না। ফলে স্বামী স্ত্রীর কোনও সম্পর্কই ছিল না তাঁদের মধ্যে। রোজ রাতে স্ত্রীকে একা রেখেই রাজকুমার বন জঙ্গলে বেরিয়ে যেতেন। এভাবে কয়েক মাস কাটার পর একদিন স্বামীকে অনুসরণ করে রাজকুমারী জঙ্গলে তাজ্জব বনে যান। তিনি দেখেন তার স্বামী অন্য এক পুরুষের সঙ্গে আবদ্ধ। এই ঘটনায় রাগান্বিত হয়ে রাজকুমারী বহুচরা রূপ ধারন করে স্বামীর যৌনাঙ্গ কেটে ফেলেন। এই ঘটনায় তার স্বামী অর্থাৎ রাজকুমার অনুশোচনায় ভুগতে শুরু করেন ও বাকি জীবন স্ত্রীকে পুজো করে কাটান।
আবার কারও মতে, একবার মেলায় যাওয়ার পথে বাপিয়া নামক এক চোরের হাতে পড়ে বহুচরা। তখন আত্মসম্মান বাঁচাতে নিজের স্তনযুগল কেটে ফেলেন তিনি। মৃত্যু যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে তিনি বাপিয়াকে অভিশাপ দেন, “তুমি নপুংশক হয়ে যাবে”। এমতবস্থায় অভিশাপ এর হাত থেকে বাঁচতে বাপিয়া দয়া ভিক্ষা করে। তখন বহুচরা বলেন,“তার নামে একটি মন্দির গড়লে তবেই এর থেকে মুক্তি হবে। তোমায় এখানে মহিলা হিসেবে থাকতে হবে”। তারপর বাপিয়ার উদ্যোগেই বহুচরার পুজো শুরু হয়। পুরুষ হয়েও বাপিয়া ওই মন্দিরে মহিলা হিসেবেই থাকতেন। তাই বহুচরাকেই রূপান্তরকামীদের দেবী বলে মানা হতে থাকে।
দেবী মোরগের ওপর অধিষ্ঠাতা এবং পবিত্রতা ও কল্যাণকারী প্রতীক রূপে পূজিতা হন। বৃহন্নলা সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত বিশ্বাস যে, তাঁরা এই দেবীরই উত্তরসূরি। এই দেবী মূলত উর্বরতার দেবী রূপে পূজিতা হন। এমনকি মনে করা হয়, যারা বিবাহের দীর্ঘদিন বাদেও সন্তান লাভ করেননি বা কোন শারীরিক অক্ষমতার কারণে সন্তান লাভে বঞ্চিত, এই দেবীর উপাসনায় তাদের মনস্কামনা পূর্ণ হয়। সাধারণ নারী থেকে দেবী হয়ে ওঠার জয়যাত্রা আর তৃতীয় লিঙ্গের সম্প্রদায়ের কাছে তাদের পরম আরাধ্যা পূজনীয় হয়ে ওঠার গল্প মন কাড়ে সাধারণ মানুষের। এভাবেই আজও গুজরাতে মহাসমারোহে পূজিত হন মাতা বহুচরা।
Discussion about this post