বিপ্লবী বাঘাযতীনের হলদিঘাট বুড়ি বালামের তীরে বীরত্বপূর্ণ সশস্ত্র সংগ্রামের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন,
“বাঙালির রণ দেখে যা তোরা
রাজপুত, শিখ, মারাঠী জাত
বালাশোর, বুড়ি বালামের
নবভারতের হলদিঘাট।”
যে সংগ্রামের কথা কবি উদাত্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন, তার সেনাপতি ছিলেন যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ওরফে বাঘাযতীন। যতীন্দ্রনাথ ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছিলেন। কিন্তু কালের নিয়মে এই বীর বিপ্লবী যোদ্ধারাও থেকে যান কেবল ইতিহাসেরই পাতায়। আজ ১০ সেপ্টেম্বর, আর আজই এই বীর বিপ্লবীকে হারানোর দিন।
যতীন্দ্রনাথের ‘বাঘা যতীন’ নামটি কে দিয়েছিলেন তা জানা যায় না। কিন্তু এর পেছনে রয়েছে এক মজার গল্প। কথিত আছে, একবার কয়াগ্রামে গিয়েছিলেন যতীন্দ্রনাথ। সেই সময় গ্রামে বাঘের খুব উৎপাত ছিল। একদিন গ্রামবাসীরা বাঘের আস্তানায় হানা দিল। খবর শুনে যতীনও ভিড়ে গেলেন বাঘ শিকারীদের দলে। তাদের মধ্যে একজনের হাতে ছিল শুধু বন্দুক। বাকিদের হাতে লাঠি, বল্লম আর দাঁ। যতীনের হাতে অবশ্য এসবের কিছুই নেই। তাঁর হাতে শুধু পেন্সিল কাটার ছুরি। হঠাৎ বাঘ দেখা গেল। তাকে লক্ষ্য করে গুলি করা হলো। কিন্তু লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো সেই গুলি। বাঘটা গেল ক্ষেপে। ক্রুদ্ধ বাঘ ঝাঁপিয়ে পড়লো যতীন্দ্রনাথের উপর। কিন্তু যতীন ঘাবড়ে যাবার ছেলে নন। তিনি তাঁর হাতের পেন্সিল কাটার ছুরি দিয়েই বাঘের সাথে লড়াই করে যেতে লাগলেন, এবং তার ছুরির ঘায়েই সাঙ্গ হল বাঘের ভবলীলা। আর তারপর থেকেই যতীন্দ্রনাথ হয়ে উঠলেন বাঘা যতীন।
এই ডানপিটে সাহসী ছেলে যে ব্রিটিশ সরকারের অত্যাচার, পরাধীনতার গ্লানি মানতে পারবে না তা বুঝে নেওয়া কঠিন নয়। কিশোর বয়স থেকেই তাঁর মনে পরাধীনতার গ্লানি, দাসত্বের অপমান গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। তিনি বুঝতে পারলেন মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় অভিশাপ হলো পরাধীনতা। এই চিন্তাই যতীন্দ্রনাথকে সংগ্রামের পথ, বিপ্লবের পথের সন্ধান দেখিয়েছিল। বাঘা যতীন কখনও ব্যক্তি বা ক্ষুদ্র-স্বার্থকে গুরুত্ব দেননি। দেশের স্বার্থ ছিল তার কাছে সবচেয়ে বড়। তিনি যখন ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার জন্য মৃত্যুকে নিত্যসঙ্গী করে দেশে-বিদেশে ঘুরছেন, বিপ্লব সংঘটিত করছেন, তখন তাকে অনেকেই তার স্ত্রী-সন্তানের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। সে সব শুনে তিনি হাসিমুখে বলেছিলেন, “সমষ্টির হিত কামনায় ব্যক্তিগত স্বার্থ উপেক্ষা করতে হবে।”
তার দলবলের এই বিপ্লবী ভাবধারা ঠাহর করতে পেরেই পুলিশ কমিশনার চার্লস টেগার্ট বিশাল পুলিশবাহিনী নিয়ে বাঘা যতীন ও তার সঙ্গী বিপ্লবীদের পিছু নিয়েছিলেন। বিপ্লবীরা অনাহারে-অর্ধাহারে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পালিয়ে যেতে লাগলেন। আর বাঘাযতীন তৈরি হচ্ছিলেন পাল্টা আক্রমণের জন্যে। একদিন বঙ্গোপসাগরের উপকূলে বুড়ি বালাম নদীর তীরে দোকানে চার সঙ্গীদের নিয়ে খেতে বসেছিলেন বাঘা যতীন। সেই খবর পুলিশে কাছে পৌঁছয়। তখনই পুলিশবাহিনী নিয়ে বালেশ্বরের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট কিলবি ও মিলিটারি লেফটেন্যান্ট রাদারফোর্ড চলে যান সেখানে। বাঘা যতীনও বিপদ আঁচ করে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হলেন। আশ্রয় নিলেন পরিখার আড়ালে। পুলিশের সঙ্গে তাঁদের গুলির যুদ্ধ শুরু হল। ১৯১৫ সালের ৯ সেপ্টেম্বর স্বাধীনতা সংগ্রামের এক পবিত্র রণক্ষেত্রে পরিণত হল বুড়িবালামের তীর। গুলির যুদ্ধে সেখানে চিত্তপ্রিয় রায়চৌধুরী শহিদ হলেন। গুরুতর আহত হলেন বাকি তিন জন। তাঁদের বন্দুকের গুলি ফুরিয়ে যায়। এই অবস্থায় ব্রিটিশ পুলিশ তাঁদের বাগে পেল।
যতীন্দ্রনাথ সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে বলেছিলেন, আমি ও আমার লেফটেন্যান্ট চিত্তপ্রিয় গুলি করেছি, বাকী এ তিনজন লোক সম্পূর্ণ নির্দোষ। তারা আমাদের সাথে এসেছিল মাত্র। তিনি মনোরঞ্জন, নিরেন ও জ্যোতিষকে ফাঁসির হাত থেকে বাঁচাতে শেষ চেষ্টা করেছিলেন। মুমূর্ষূ যতীন্দ্রনাথকে বালেশ্বর হাসপাতালে পাঠানো হলো। তাঁর মাথায় ব্যান্ডেজ করা হয়। যতীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “দখলদার সরকার আমাকে সুস্থ করিয়ে ঘটা করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে বাহবা নেবে তা হতে পারে না।” এ কথা বলেই ব্যান্ডেজ খুলে মগজের ভিতর আঙুল ঢুকিয়ে মগজে টান দেন। ১৯১৫ সালের ১০ সেপ্টেম্বর তিনি বালেশ্বরের হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। যদিও যতীন্দ্রনাথের শেষ অনুরোধ রক্ষা করার মতো ঔদার্য বিদেশী রাজশক্তির ছিল না। বিশেষ আদালতের বিচারে মনোরঞ্জন ও নিরেশের ফাঁসির হুকুম হয়, জ্যোতিষের হয় যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর।
মাত্র ৩৬ বছর বয়সে যতীন্দ্রনাথের বিপ্লবী-জীবন শেষ হয়। তাঁর প্রতিজ্ঞা ছিল বিস্ময়কর। অচিন্তনীয় ছিল তাঁর শক্তি ও বীরত্ব আর অপরিমেয় দেশপ্রেম। যতীন্দ্রনাথের মৃত্যুর পরে পুলিশ কমিশনার টেগার্ট তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করে বলেন, “I have met the bravest Indian. I have the greatest regard for him but I had to do my duty.”
তাঁর লাশ কোথায় কী করা হলো জানা গেল না। মানুষের মুখে মুখে অমর হয়ে গেলেন মুক্তির লড়াইয়ের মহান সৈনিক বিপ্লবী বাঘা যতীন আর তাঁর বিপ্লবী সাথী। কবির কবিতায় বিধৃত হলো কাহিনী।
“বৃটিশের সাথে যুদ্ধ করেছে
তোমরা পঞ্চবীর
বুকের রক্তে রাঙায়ে দিয়েছে
বুড়ী বালামের তীর।”
Discussion about this post