সংস্কৃতির পীঠস্থান আমাদের এই বাংলা। বঙ্গদেশের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে বহু প্রাচীন শিল্প-সংস্কৃতি। প্রাচীন এই সংস্কৃতি গুলির অন্যতম ঐতিহ্যবাহী ‘বহুরূপী সাজ’। ছেলেবেলায় ‘বহুরূপী’ নামটা শুনলেই আমাদের সামনে ভেসে উঠতেন জীবন্ত দেব দেবীরা। বর্তমানে বারাসাত অঞ্চল তথা সারা বাংলার বহুরূপীদের কথায় প্রথমেই সকলের মনে আসে বহুরূপী অভিজিৎ বাবুর কথা। বাংলার হাতে গোনা বহুরূপী সাজা মানুষদের মধ্যে তিনিই অন্যতম। বাংলার এই আদিম সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে আজও তিনি সযত্নে বাঁচিয়ে রেখেছেন, নিজের শিল্প কর্মের মধ্যে দিয়েই।
পুরো নাম তার অভিজিৎ নস্কর, বয়স প্রায় ৭৬ বছর। তবে লোকে তাকে চেনেন ‘বহুরূপী কুমার অভিজিৎ’ নামেই। অভিজিৎ বাবুর বাড়ি বারাসাতের বুড়িগঙ্গা অঞ্চলে। জীবনের প্রথম দিকে থিয়েটার ও সিনেমাতে অভিনয় করতেন অভিজিৎ বাবু। মোহন চট্টোপাধ্যায় থেকে নট্ট সম্রাট স্বপন কুমারের সাথে অভিনয় করেছেন তিনি। তার জীবনের অন্যতম স্বপ্ন ছিল উত্তম কুমারের সাথে অভিনয় করা। তার অভিনয়ের দক্ষতা খুব শীঘ্রই তাকে মিলিয়ে দেন তার স্বপ্নের অভিনেতার সাথে। পরপর তিনি ডাক পান উত্তর কুমারের ‘হারানো সুর’ ও ‘অমানুষ’ সিনেমায় অভিনয়ের জন্য।
সব মিলিয়ে প্রায় ৩১৪ টি যাত্রা ও সিনেমায় অভিনয় করেছেন তিনি। তবে হঠাৎই উত্তম কুমারের মারা যাওয়ার পর ভেঙে পড়েন অভিজিৎ বাবু। ছেড়ে দেন অভিনয়, শুরু হয় তার জীবনের নতুন অধ্যায়। এরপরই তিনি বহুরূপী সাজা শুরু করেন। শোনা যায়, একবার তার সাজে মুগ্ধ হয়ে ১০ হাজার টাকা পুরস্কার স্বরূপ তার হাতে তুলে দেন স্বয়ং হেমা মালিনী। রবীন্দ্রনাথ থেকে শ্রী কৃষ্ণ কিংবা রামায়ণের ভীম, অর্জুন বা কখনও হনুমান রূপে ঘুরে বেড়ান তিনি। ২৮ বছর ধরে এই কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। বর্তমানে ‘বহুরূপী’ সাজা তার নেশা। কেবল পুরস্কার আর অর্থের টানে নয়, মানুষের ভালোবাসা আর আশীর্বাদ এর জন্য অভিজিৎ বাবু আজও বহুরূপী সেজে চলেছেন। সারাবছর গ্রাম বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের পূজা-পার্বণে বিভিন্ন রূপে সেজে ঘুরে বেড়ান তিনি।
শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ উপন্যাসের শ্রীনাথ বহুরূপী কিংবা সুবোধ ঘোষের ‘বহুরূপী’ গল্পে বিরাগী হরিদাসদের কথা, বাংলার সাহিত্য জুড়ে খুঁজে পাওয়া যায় প্রাচীন এই শিল্পের ছোঁয়া। শখ পূরণের পাশাপাশি প্রাচীন এই শিল্পগুলির সাথে মিশে রয়েছে উপার্জনের তাগিদে। আধুনিকতার সাথে তাল মিলিয়ে বহু প্রাচীন শিল্প আজ হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রাচীন এই শিল্পের সাথে জড়িয়ে থাকা শিল্পীরা হয়ে যাচ্ছেন কর্মহীন। এই পরিস্থিতি থেকে বেড়িয়ে আসার অন্যতম মাধ্যম সরকারি সহযোগিতা। সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজন বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ। তবেই ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য বাঁচিয়ে রাখা যাবে বাংলার এই শিল্প সম্পদগুলিকে।
Discussion about this post